
মহাভারতের কথা: একটি গুপ্তহত্যা এবং এক আত্মহননের আগ্নেয় সমীকরণ
রঞ্জন ভট্টাচার্য্য
" অগ্নি কৃতঘ্ন - অগ্নিকে ধিক্কার দি " - কথাগুলি নিদারুণ দুঃখে ও রাগে অস্থির হয়ে বলেছিলেন যুধিষ্ঠির। তাঁর এই কথাগুলি আমরা শুনেছিলাম মহাভারতের আশ্রমবাসিক পর্বে। যুধিষ্ঠিরের চোখে সেই মুহূর্তে অগ্নি কতটা কৃতঘ্ন কিংবা কতটা ধিক্কারের যোগ্য সে বিষয়ে এখন মহাভারতের পথে অনুসন্ধান করবো।
এই অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করতে পারবো এক আশ্চর্য সমীকরণ। বহু বছরের ব্যবধানের দুটি ঘটনার এক সমীকরণ। ঘটনা দুটির একটি হলো এক বীভৎস গুপ্তহত্যা । আরেকটি অতি ভয়াবহ আত্মহনন। ঘটনা দুটির প্রেক্ষিত স্বাভাবিক ভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্ন। তা সত্ত্বেও তারা পাশাপাশি চলে আসে এক আশ্চর্য সমীকরণে। কিন্তু কিভাবে সেটি সম্ভব এবার সেই প্রাসঙ্গিকতায় আসার চেষ্টা করছি।
সেই সূত্রেই এখন আমরা যুধিষ্ঠিরের যে উক্তিটি দিয়ে এই আলোচনার শুরু হয়েছে তার সারবত্তা যাচাইয়ের প্রয়াস করবো। এই জন্য অগ্নির সঙ্গে পান্ডবদের ( আরো নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে অগ্নির সঙ্গে অর্জুনের ) প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ছবিটি আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে ।সেই কারণেই আমরা এখন পিছিয়ে যাবো মহাভারতের পথ ধরে খান্ডবদহনের অধ্যায়ে। খান্ডবদহনের বিশদে না গিয়ে আমরা মূলঘটনার সারবস্তুটি প্রকাশ করছি।
আদিপর্বের একেবারে শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই কৃষ্ণ ও অর্জুন নিজেদের অনুচরদের নিয়ে যমুনা নদীর তীরে খান্ডববনে অলস সময় যাপন করছিলেন । খান্ডববনের শোভা অতি মনোরম। সেখানে অসংখ্য পশুপাখির বাস। কৃষ্ণ আর অর্জুন যখন নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা করছিলেন তখন সেখানে হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন এক উগ্রমূর্তি পুরুষ । তাঁর মাথায় বিরাট এটা পরিধানে চীরবাস। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন -' আমি অগ্নি । আমি এই খান্ডববনকে আমার ভোজ্য হিসেবে দহন করতে চাই। কিন্তু ইন্দ্রের সখা তক্ষকনাগ এখানে সপরিবারে বাস করে বলে ইন্দ্র এই অরণ্যকে রক্ষা করেন। তোমরা যদি উত্তম অস্ত্রবিদ হিসেবে আমার সহায় হও তাহলে আমি তোমাদের সহায়তায় এই খান্ডবদহন করতে পারি। '
এই বক্তব্যের পূর্বাপর কয়েকটি ঘটনা আছে যার ভিতরে আমরা যাবো না। এই আলোচনায় শুধু এটিই বলার প্রয়োজন যে অর্জুন রাজি হলেন। কিন্তু ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করার উপযুক্ত অস্ত্রগুলি পাওয়ার সাপেক্ষে। এইভাবে অর্জুন পেলেন তাঁর বিখ্যাত গান্ডীবধনু। কৃষ্ণ পেলেন তাঁর বিখ্যাত সুদর্শন চক্র। এছাড়া পেলেন দুটি অক্ষয় তূণ এবং একটি দিব্যরথ। এগুলির সাহায্যে কৃষ্ণ ও অর্জুন গোটা খান্ডববন দগ্ধ করলেন ( কেবল ছটি প্রাণ রক্ষা পেয়েছিলো )। ইন্দ্র বহু চেষ্টাতেও কৃষ্ণ ও অর্জুনকে প্রতিহত করতে পারলেন না। অগ্নি অসংখ্য পশুপাখির সঙ্গে গোটা খান্ডববনকে ভষ্মীভূত করে তৃপ্তি পেলেন। এর পরিবর্তে অর্জুন পেলেন তাঁর বিখ্যাত গান্ডীবধনু, অক্ষয়তূণ এবং দৈবরথ। এরপরেও অর্জুন প্রতিশ্রুতি পেলেন ইন্দ্রের যাবতীয় অস্ত্র ভান্ডারের , অগ্নির সমস্ত আগ্নেয় ও বায়বীয় অস্ত্রের। এগুলি তিনি অবশ্যই পেয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়। অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণার্জুনের অপরাজেয় হওয়ার পিছনে এই অস্ত্রগুলির অবদান অসামান্য।
তাই এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে অগ্নির সঙ্গে অর্জুনের ( তথা পান্ডবদের) সম্পর্কটি কোনো একতরফা গ্রহীতা ও দাতার সম্পর্ক ছিলো না । কৃষ্ণ ও অর্জুন খান্ডববন দহন করে অগ্নিকে যেমন তৃপ্ত করেছিলেন, তেমন অগ্নির থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র গুলি দুহাত ভরে গ্রহণ করেছিলেন। এগুলিই তাঁরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ও অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছিলেন। অগ্নির এই অসামান্য প্রতিদানটির কথা যুধিষ্ঠিরের সেই তীব্র শোকাতুর মুহূর্তে মনে পড়েনি। তাই চরম দুঃখের আঘাতে আচ্ছন্ন হয়ে অগ্নির প্রতি অভিযোগ করে যে কথাগুলি তিনি বললেন যা অবশ্যই তর্ক সাপেক্ষ। অগ্নির সঙ্গে পান্ডবদের ( মূলত অর্জুনের) এই প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ( সোজাসুজি বলতে গেলে এই পারস্পরিক দান- প্রতিদানের সম্পর্কের ) বিষয়টি মহাভারতে অতি সুস্পষ্ট।
আমরা এখন এই কাহিনীটিকে মাঝখানে রেখে মহাভারতের পথে অনেকটা পিছিয়ে এবং এগিয়ে যাবো। যাবো।দুটি ভিন্ন ঘটনার অনুসন্ধানে। যেখানে অবশ্যই অগ্নি আছেন। আছেন পান্ডবদের সঙ্গে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে নয়। প্রচ্ছন্নভাবে।
প্রথমে আমরা পিছিয়ে যাবো খান্ডবদহনের ঘটনাটি থেকে বেশ কিছু কাল আগের একটি ঘটনায়। আমরা চলে আসবো মহাভারতের আদিপর্বে।আরো নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে আদিপর্বের জতুগৃহদাহ উপপর্বের অধ্যায়টিতে।
মহাভারত- পাঠক মাত্রেই অল্পবিস্তর জানেন এই জতুগৃহদাহ ঘটনাটি। পান্ডবদের দ্রুত বেড়ে ওঠা জনপ্রিয়তায় ঈর্ষা করে এবং কিছুটা ভয় পেয়ে দুর্যোধন তাদের গুপ্তহত্যা করার জন্য বারণাবত নগরীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে পুরোচন নামে এক বিশ্বস্ত কর্মচারীকে দিয়ে একটি জতুগৃহ তৈরি করিয়েছিলেন। এবং পান্ডবদের সেখানে থাকার বন্দোবস্ত করিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পান্ডবদের বারণাবতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিদুর যুধিষ্ঠিরকে একটি বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই সতর্কতা মাথায় রেখে যুধিষ্ঠির এমন ভাবে চলতে থাকলেন যাতে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ না হয় যে তিনি বা পান্ডবরা এবিষয়ে কিছুমাত্র ধারণা করতে পেরেছেন। তাই সেইমতো পান্ডবেরা ওই জতুগৃহেই এসে উঠলেন। এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকলেন। এই ঘটনাটি যে কোনো মহাভারত - পাঠকের কাছে সুবিদিত।
ইতিমধ্যে বারণাবত নগরীর বহু মানুষের সঙ্গে পান্ডবদের পরিচয় ও সুসম্পর্ক হলো। অর্থাৎ তাঁরা ওখানেও যথেষ্ট লোকপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বারণাবত নগরীর সাধারণ মানুষের কাছে এইভাবে নিজেদের এমন চমৎকার ভাবমূর্তি তৈরি করার ব্যাপারটা ছিল পান্ডবদের জন্য যুধিষ্ঠিরের পরিচালনায় একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। কিংবা বলা যায় দুর্যোধন অর্থাৎ কৌরবদের ষড়যন্ত্রকে ঠেকাতে যুধিষ্ঠির অর্থাৎ পান্ডবদের এক পাল্টা রাজনৈতিক পন্থা। এইবার এই পন্থাটি কিভাবে কোথায় এসে কোন প্রাপ্তি ( প্রাপ্তিটি অবশ্যই প্রত্যক্ষভাবে পান্ডবদের, কিন্তু পরোক্ষভাবে পাঠকদেরও ) নির্ধারণ করলো তা আমরা দেখতে চেষ্টা করবো।
তাই এইবার আমরা চলে আসি এই ঘটনাটির প্রসঙ্গে। তখন মধ্যরাত। বারণাবত নগরীর অধিবাসীরা নিদ্রামগ্ন। হয়তো তাদের কেউ কেউ তখন সুখস্বপ্নে ভাসমান । কিন্তু কয়েকজন যেন নিদ্রার অতলে অচৈতন্য। এরা পাঁচজন নিষাদ ও একজন নিষাদী । এরা সকলেই আকন্ঠ মদ্যপান করে প্রায় সংজ্ঞাহীন। আজন্ম বুভুক্ষু নিঃস্ব মানুষদের সামনে বিপুল খাদ্যপানীয়ের ভান্ডার সাজিয়ে দিলে যা হয়। বিশেষত তার যদি আসে অবারিত রাজ- অনুগ্রহে। কারণ রাজবধূ কুন্তী সেই আয়োজনই করেছিলেন। তাদের বারণাবতের প্রজাসাধারণের জন্য। এক বিরাট পান ভোজনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো তাঁদের বারণাবতের 'শিবভবন ' বাসগৃহে। ' শিবভবন ' - অর্থাৎ যে বাসস্থান মঙ্গলময়। সেই শুভালয়ে অন্যান্য প্রজাদের সঙ্গে এসেছিলো একটি নিরীহ নিঃসম্বল নিষাদ পরিবার। তারা পাঁচ ভাই। আর সঙ্গে তাদের মা। তাদের জন্যেও ছিলো প্রচুর সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয়। মাত্রাহীন মদ্যপানে অচৈতন্য হয়ে ওই শিবভবনেই পড়ে রইলো ওই আজন্মের অর্ধভুক্ত মানুষগুলি। আর ঠিক এই মুহূর্তটিরই অপেক্ষায় ছিলেন কুন্তী ও তাঁর পাঁচ পুত্র।
হঠাৎ বাতাস প্রবলভাবে বইতে শুরু করলো। পঞ্চপান্ডবরা আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। মধ্যমপান্ডব অর্থাৎ ভীম যিনি এই ধরণের কাজে স্বভাবতই অগ্রণী তিনিই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অগ্নি সংযোগ করলেন ওই বাসভবনের সর্বত্র। প্রবল বায়ুর অনুকূলে সেই অগ্নিশিখা নিমেষেই বহুবর্ধিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করলো ওই বাসস্থানটিকে। পান্ডবরা কুন্তীকে নিয়ে গুপ্তপথে যখন অনেক নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন , তখন শিবভবন এক অশিবক্ষেত্র হয়ে পড়ে রইলো ছয়জন নিরপরাধ বুভুক্ষুর দগ্ধাবশেষ নিয়ে। মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্ররহিত হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতম উদাহরণ হয়ে।
কিন্তু এর দ্বারা পান্ডবদের যে প্রাপ্তি হলো যা রাজনৈতিক হিসেবে যথেষ্ট। (কারণ একজন মহিলা ও পাঁচ জন পুরুষের দগ্ধাবশেষ থেকে দুর্যোধন তথা কৌরবরা সেই ভষ্মীভূত দেহগুলি কুন্তী ও পান্ডবদের বলে বিভ্রান্ত হলেন )। আর আমরা মহাভারত পাঠকেরা শিহরিত হয়ে দেখতে পেলাম একটি নৃশংস গুপ্তহত্যা ( নিরীহ নিরপরাধ কয়েকজনের সঙ্গে একটি নারীহত্যা) যাকে মহাভারতের অন্যতম গর্হিত কাজ বলা যায়।
এরপর আমরা মহাভারতের পথে চলতে চলতে দেখতে পাবো অসংখ্য নরহত্যা ও নৃশংসতা। সেগুলির অধিকাংশই মহাভারতের বিভিন্ন কুশীলবদেব হত্যাকাণ্ড। সেই ঘটনাগুলি ধারে ও ভারে এত বেশি যে আমরা আমাদের অজান্তেই ভুলে যাই মহাভারতের এই নগন্য মানুষগুলির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। এই ছ জন নিরপরাধ হতদরিদ্র মানুষের যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটলো তাঁরা কিন্তু কোনো ভাবেই মহাভারতের কোনো কুশীলব হওয়া তো দূরের কথা , কোনোপক্ষের কোনো বিবাদের সঙ্গে সামান্যভাবেও সম্পর্কিত ছিলেন না । তাহলে কেন এদের এইভাবে মরতে হলো?
মহাভারতকার খুব আলগোছে এর একটি কারণ ( নাকি কৈফিয়ৎ?) জানিয়েছেন, একটি নির্দিষ্ট শব্দের দ্বারা। তাঁরা " কালনির্দিষ্ট " হয়ে এইভাবে মর্মান্তিক পরিণতি পেয়েছিলেন। এই "কালের দ্বারা নির্ধারিত " কিংবা "কালের দ্বারা প্রযুক্ত" ইত্যাদি শব্দবন্ধগুলি মহাভারতে অসংখ্যবার " ব্যবহৃত " হয়েছে। তাই মহাভারতের এই বিপুলপাঠের ভারে এই ঘটনার এই কারণ-নির্দেশটি যেমন আলগোছে বলা হয়েছে তেমন এই ঘটনাটি আলগাভাবেই ভেসে বেরিয়ে যায় আমাদের স্মৃতি থেকে। কিন্তু কালের হিসেব থেকে তার অত সহজে মিলিয়ে যেতে পারে না।। মহাভারতকার কিন্তু এই কালের মাপকাঠিটি পেতে রেখেছেন আমাদের অলক্ষ্যে।
এই কালের' হিসেবটি আমরা দেখতে পাবো এই জতুগৃহদাহ ঘটনাটির বহুবছর বাদে। তার জন্য খান্ডবদহনের ঘটনাটিকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে মহাভারতের পথে এর অনেক পরের সময়ের আঙিনায়। চলে আসতে হবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বহুবছর পরের একটি ঘটনায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো।। অশ্বমেধ যজ্ঞের পর যুধিষ্ঠির সিংহাসনে বসলেন। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীকে তাঁদের স্বমর্যাদায় সযত্নে আগলে রেখে তিনি রাজ্য পালন করতে থাকলেন। এইভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গেলো। এইসময় ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী স্বেচ্ছায় বনবাস গ্রহণ করতে চাইলেন। কুন্তীও সেই মত দিলেন। যুধিষ্ঠিরের শত অনুরোধেও তাঁদের সিদ্ধান্ত অটল রইলো। অতএব তাঁরা তিনজন একসঙ্গে বসবাস যাত্রা করলেন।। তাঁদের সঙ্গে গেলেন বিদুর ও সঞ্জয়। গভীর অরণ্যে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী ও বিদুর কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন।
এর কিছু কাল পরে যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য পান্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তখন সেখানে বিদুরকে দেখতে না পেয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর সন্ধানে বের হলেন । শেষপর্যন্ত যুধিষ্ঠির বিদুরের দেখা পেলেন। বিদুর আশ্চর্য ভাবে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে প্রাণত্যাগ করলেন। এরপর যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য পান্ডবরা রাজধানীতে ফিরে এলেন। এই ঘটনার কিছু কাল বাদে দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় এসে বললেন যে তিনি অনেক স্থান ও তীর্থ ভ্রমণ করে আসছেন। সেই শুনে যুধিষ্ঠির মহর্ষি নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন যে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা এবং হয়ে থাকলে তিনি কেমন আছেন।
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নারদের কাছে সহজ ছিলো না। কারণ এর উত্তরটি ছিল অবিশ্বাস্যভাবে মর্মভেদী। অন্তত প্রশ্নকর্তার কাছে। বিশেষত প্রশ্নকর্তটি যখন যুধিষ্ঠির। যিনি মহাভারতের সবচেয়ে সংবেদনশীল চরিত্র। । কিন্তু নারদকে যুধিষ্ঠিরের এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হলো। মহর্ষি নারদ বললেন অতি সংযত ভাবে। পরোক্ষভাষণে। ঘটনাচক্র অনুযায়ী প্রত্যক্ষভাবে উত্তর দেওয়ার উপায় তাঁর ছিলো না । কারণ তিনি যা বললেন তার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি নন । সমস্তটাই তাঁর শোনা কথা। ঘটনাটি তিনি শুনেছেন মাত্র। শুনেছেন গঙ্গাতীরবাসী তপস্বীদের মুখ থেকে। যাদেরকে এই ঘটনাটি বলেছেন সঞ্জয়। যিনি প্রকৃত ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।
নারদ বললেন - 'কোনো একদিন ধৃতরাষ্ট্র গঙ্গাস্নান করে গঙ্গার তীর দিয়ে আসছিলেন। সেই সময় হঠাৎ বিশাল দাবাগ্নি দেখা গেলো। বনের সমস্ত পশুপাখিরা দিগবিদিকে পালাতে লাগলো। ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী ও কুন্তী তাঁদের অশক্ত শরীরে দ্রুত অন্যত্র চলে যেতে সমর্থ হলেন না। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে অন্যত্র চলে যেতে বললেন। এবং নিজেরা স্বেচ্ছায় এই আগুনে আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে রুদ্ধ করে একটি কাঠের খন্ডের মতো নিশ্চল হয়ে অগ্নিস্যাৎ হলেন। সেই সঙ্গে গান্ধারী ও কুন্তীও ওই দাবাগ্নিতে ভস্মীভূত হলেন।'
এই বিবৃতিটি দিয়ে মহর্ষি নারদ জানালেন যে এই কথাগুলি তিনি গঙ্গাতীরবাসী মুনিদের থেকে শুনেছেন। মুনিরা এই ঘটনাটি শুনেছেন সঞ্জয়ের মুখে। দাবাগ্নি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে সঞ্জয় ওই মুনিদের আশ্রমে এসেছিলেন। তখনই সঞ্জয় ওনাদের এই ঘটনাটি বলেন।তারপর তিনি চলে গেছেন হিমালয় পর্বতের পথে। নারদ আরো বললেন যে তিনি ওই পথে চলতে চলতে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর দগ্ধশরীরগুলি নিজের চোখে দেখেছেন। সবশেষে তিনি বললেন যে ধৃতরাষ্ট্রেরা স্বেচ্ছায় এই ভাবে অগ্নিপ্রাপ্ত হয়ে স্বর্গে গেছেন, তাই তাঁদের জন্য কোনো শোক করা উচিত নয়।
মহর্ষি নারদ যাই বলুন যুধিষ্ঠিরের কাছে এর চাইতে মর্মান্তিক সংবাদ আর কিছুই হতে পারতো না। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে শোকে আকুল হয়ে উঠলেন। হাহাকার করতে থাকলেন। এবং সেই সময়েই বললেন -' অগ্নিকে ধিক। এই অগ্নি একদিন ভিখারীর বেশে অর্জুনের কাছে প্রার্থী হয়ে এসেছিলেন। অর্জুন তার উপকার করেছিলেন । অগ্নি সেই উপকার স্মরণ না রেখে তাঁর মাকে ( অর্থাৎ কুন্তীকে ) এই ভাবে দগ্ধ করে প্রাণনাশ করলেন।'
এখানে লক্ষ্যনীয় যে ঠিক কি ঘটেছিলো ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর শেষ সময়ে তার কোনো বর্ণনা আমরা পাই না। মহাভারত-কার এ বিষয়ে সরাসরি কোনো বর্ণনা দেন নি। কারণ এই মর্মান্তিক ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। একমাত্র সঞ্জয় ছাড়া। যিনি আগুন লাগার অল্পক্ষণ বাদেই অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে। কিন্তু চলে যাওয়ার আগের মুহূর্তে তিনি যা দেখেছিলেন তার বিবরণ অতি সামান্যই -' ধৃতরাষ্ট্র সমস্ত ইন্দ্রিয়কে রুদ্ধ করে কাঠের মতো পড়ে রইলেন। আর এই সময়েই গান্ধারী ও কুন্তী দাবানলে আক্রান্ত হলেন। ধৃতরাষ্ট্রও ওই দাবাগ্নির কবলে পড়লেন।' আমরা এইটুকুই জানলাম। দেবর্ষি নারদের কয়েক মুহূর্তের যৎসামান্য বিবৃতিতে।
আর এই মুহূর্তটিতেই আমরা মহাভারত পাঠকরা এই ভারতকথার তিনটি স্তম্ভকে হঠাৎ লুপ্ত হয়ে যেতে দেখলাম। আমরা হতচকিত হয়ে জানলাম ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তী দাবানলে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সঞ্জয়ের বিবৃতিকে পুরোপুরি অনুসরণ করে বলা যায় তাঁরা ওই আগুনে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন।
এই কথাটি জানার মুহূর্তের মধ্যেই এটি আমাদের কাছে আর নিছক তথ্য হয়ে থাকে না। আমরা যেন অকস্মাৎ বিদ্যুৎ বাহিত পথে ফিরে যাই সূদূর অতীতে । আবার এসে দাঁড়াই আগুনের সর্বনাশা লেলিহান শিখার সামনে । যে আগুন গ্রাস করে নিচ্ছে ঘুমন্ত অসহায় কয়েকটি মানুষকে - শিবভবনে' । আমাদের অবধারিত ভাবেই মনে পড়ে জতুগৃহদাহের বীভৎস গুপ্তহত্যার ঘটনাটিকে।
শিবভবনের ওই ভয়ঙ্কর গুপ্তহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন কুন্তী স্বয়ং। একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীকে তিনি হত্যা করেছিলেন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় অগ্নির সাহায্যে। এই গুপ্তহত্যার বহুকাল বাদে মহাভারতের পথে যখন আমরা অজস্র হত্যাকাণ্ডের রক্তস্রোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, - কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অসংখ্য রথী মহারথীর মৃতদেহ অতিক্রম করে শান্তিপর্বের এবং অনুশাসন পর্বের বহুবিচিত্র তত্ত্ব তথ্য আর কাহিনী উপকাহিনীর ভারে ক্লান্ত হয়ে বিস্মৃত হয়েছি আদিপর্বের ওই নগন্য মানুষগুলির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি - ঠিক তখনই আমাদের সামনে এলো আশ্রমবাসিক পর্বের এই অগ্নিগ্রাসের ঘটনাটি। যে অগ্নিগ্রাস ছিলো অবশ্যই এক আত্মহননের পন্থা।
এবার কুন্তীকে কেন্দ্রে রেখে আমরা দুটি ঘটনাবৃত্ত দেখতে পাচ্ছি। প্রথম বৃত্তটি জতুগৃহে গুপ্তহত্যার ঘটনা।আর দ্বিতীয় বৃত্তটি দাবানলে আত্মবিসর্জনের ঘটনা। প্রথম ঘটনাটিতে কুন্তী 'প্রবৃত্ত' হয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই পরিস্থিতি থেকে প্রাণে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ( নয়তো দুর্যোধনের চর পুরোচন ওই জতুগৃহেই তাঁকে তাঁর পাঁচ পুত্রসমেত পুড়িয়ে মারতো)।আরেকটিতে তিনি 'নিবৃত্ত' হলেন আত্মরক্ষার কোনো রকম পন্থা নেওয়া থেকে - ওই পরিস্থিতিতে প্রাণবিসর্জন দেওয়ার জন্য। ( কারণ ওই আগুনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা তিনি করেন নি।)
দুটি ঘটনাতেই কুন্তী ওতপ্রোতভাবে জড়িত রইলেন। একটিতে হত্যাকারীর ভূমিকায়। অন্যটিতে আত্মহননকারীর ভূমিকায়। মহাভারতের অতিবিস্তীর্ণ পটভূমিতে এই দুটি ঘটনা স্থান ও কালের হিসেবে পরস্পরের থেকে বহুদূরে অবস্থিত। কিন্তু এই বিষম দুটি ঘটনাকে ঘটিয়েছেন একটি বিশেষ চরিত্র - তিনি অগ্নি। সবকিছুর কারক তিনিই।
মহাভারতকার বোধহয় জানতেন যে এভাবেই ' মেলাবেন তিনি মেলাবেন ' একটি গুপ্তহত্যা ও একটি আত্মহননকে অগ্নির দ্বারা এক আশ্চর্য সমীকরণে।

কৃত্রিম প্রজননে শাবক প্রসব করানোর কৃতিত্ব এই বঙ্গসন্তানের
শৌনক ঠাকুর
যদি জানতে চাওয়া হয় বন্দীদশায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কোথায় প্রথম গন্ডার শাবক প্রসব করানো হয়েছিল? স্বভাবতই আমাদের স্মৃতি বিদেশি কোন জায়গার নাম অনুসন্ধান করা করবে। কিন্তু আমরা প্রায় অনেকেই জানি না যে আজ থেকে প্রায় ১৩৬ বছর আগে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। হ্যাঁ, আমাদের চির পরিচিত সেই আলিপুর চিড়িয়াখানা। কলকাতা। এই কান্ডটি যিনি ঘটিয়েছিলেন কোন ইংরেজ নন , একজন বাঙালি — রামব্রহ্ম সান্যাল।
রামব্রহ্ম সান্যালই আলিপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম ভারতীয় অধিকর্তা বা সুপারিনটেনডেন্ট। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার কাছে মহুলা গ্রামে। সালটি ১৮৫৮ (১৩ অক্টোবর)। বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়। রামব্রহ্মের পিতা ছিলেন বৈদ্যনাথ সান্যাল। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। রামব্রহ্ম বহরমপুরের কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারিতে ভর্তিও হন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। মোটামুটি তিনবছর পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। তার দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে থাকে। তখন বাধ্য হয়েই ডাক্তারি পড়া মাঝ পথে ছাড়তে হয়। তবে স্থিতধী , পরিশ্রমী ,বুদ্ধিমান , বিচক্ষণ রামব্রহ্ম সহজেই নজর কেড়েছিলেন অধ্যাপক জজ কিং এর।
এই জজ কিং তাকে প্রথমে আলিপুর চিড়িয়াখানায় একটা কাজ দেন। কুলি-মিস্ত্রীদের তদারক করা। তখন অবশ্য চিড়িয়াখানাটি নির্মাণ হচ্ছিল। চিড়িয়াখানা তৈরি হবার পর তিনি হলেন হেডবাবু। সাল ১৮৭৭। কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রমের গুণে তিনি সুপারিনটেনডেন্ট পদ অলংকৃত করেন। বাল্যকাল থেকেই পশু-পাখিদের প্রতি তার ছিল একটা আলাদা আগ্রহ। ছুটিতে বাড়ি ফিরে তিনি বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন প্রকার গাছগাছালি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। খোঁজ নিতেন গ্রামের গৃহপালিত পশুদের।
পশুদের প্রতি তার এই ভালোবাসা যেন সহজাত। চিড়িয়াখানায় জীবজন্তুদের স্বাস্থ্য , খাওয়া-দাওয়া , বাসস্থান ইত্যাদি বিষয় তিনি নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। দু’বেলা ঘুরে ঘুরে পশুদের দেখতেন। ঋতু অনুযায়ী থাকার সুব্যবস্থা করেছিলেন।
পশুদের বিজ্ঞানসম্মত নাম, তাদের দৈহিক পরিবর্তন, তিনি নোট করে রাখতেন। অসুস্থ হলে তিনি পশু চিকিৎসক ডাকতেন। ছোটখাটো অপারেশনে ওখানে হত। কোন পশু মারা গেলে তার পোস্টমটম করা হত। সেই রিপোর্ট তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাতেন। পশুদের বিষয়ে তার নোট বা পর্যবেক্ষণ কতটা গভীর ছিল একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই —
“The Dolphin has an elongated body, and a long compressed beak provided with large conical teeth, which are rather sharp-pointed in young, but become worn down as the animal grows old. Its dimensions vary from seven or eight to even twelve feet; the colour is uni-formly black or greyish black. This aquatic animal is perfectly blind, because its eyes are not only rudimentary but completely buried beneath the thick, opaque hide of the head. There is, however, nothing strange in this deprivation of sight, which would be useless to a beast which lives in thick muddy water. Any one who has sailed often in the Ganges, the Brahmaputra, or the Indus cannot have failed to notice that these animals do not show themselves always and everywhere in these rivers. They are migratory in habits and desert such parts as become clear and shallow during the summer for others which are deep and dirty. Their food con sists of fish and prawns, and also, it is said, crabs; but this requires confirmation. Dolphins are sometimes captured by fishermen, either accidentally or on purpose, as their oil is said to possess great efficacy in curing rheumatism and allied disorders.”
তার রেজিস্টার থেকে জানা যায় , একবার খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দুটি বাঘ। মিস্ত্রিরা হয়তো কাজ করার পর খাঁচার দরজা বন্ধ করতে ভুলে যান। অবশ্য বহু চেষ্টাতেও বাগে আনা যায় নি বাঘ দুটিকে। তখন বাধ্য হয়েই গুলি করা হয়েছিল। এই ঘটনা তাকে খুব ব্যথিত করেছিল। শুধু তিনি কেন আমরা যারা এই রচনাটি পড়ছি তাদেরকেও মন নিশ্চিতভাবেই ব্যথিত হবে।
পাখিদের বাসা তৈরি , শিকার ধরার কৌশল ইত্যাদি বিষয় নিয়েও তিনি গবেষণা করেছিলেন। মাছরাঙ্গা পাখির শিকার ধরার কৌশল তিনি যথেষ্ট দক্ষতাই বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখছেন — মাছরাঙার খাবার হয় ছোট মাছ। মাছরাঙার মধ্যে এই গুণগুলি অসাধারণ মাত্রায় বিদ্যমান। শিকার জলের ওপর ভেসে উঠলেই, মাছরাঙা একেবারে তীরের মতো ছুটে যায়, চোখের পলকে শিকার ধরে ফেলে, এবং আবার দ্রুত তার নির্ধারিত জায়গায় ফিরে আসে।
বাংলাদেশের স্ত্রী গন্ডার ও সুমাত্রার পুরুষ গন্ডারের মিলনে একটি গন্ডার শাবক জন্ম নিল। বন্দী দশায় গন্ডারের জন্ম ভারতের ইতিহাসে প্রথম। যেখানে আজকের মত চিকিৎসা বিদ্যা বা শল্যচিকিৎসা এতটা উন্নত ছিল না। নিজে দক্ষতায় বুদ্ধিমত্তায় এবং সাহসের সঙ্গে কৃত্রিম প্রজননের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। এছাড়াও সাপের বিষ নিয়ে ওখানে গবেষণা চলত।
চিড়িয়াখানার ভিতরে লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৮৮০ সালে চিড়িয়াখানার ভেতর ইলেকট্রিক ট্রেন চালানো হয়। এই চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছিলেন বহু বিশিষ্টজন। এসেছিলেন তার মধ্যে অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ , ভগিনী নিবেদিতা , স্বামী বিবেকানন্দ ,স্বামী যোগানন্দ প্রমুখ বিশিষ্টজন।
……………..
গ্রন্থঋণ
১. “A hand-book of the management of animals in captivity in Lower Bengal” : by Sanyal, Ram Bramha
২. বাংলা চরিতাবিধান
৩. “তাঁর আমলে চিড়িয়াখানায় ওয়াজিদ আলি শাহ থেকে বিবেকানন্দ” : আনন্দবাজার রিপোর্ট : গায়ত্রী সেন ২৬ জানুয়ারি ২০২০

যুদ্ধ ও কবিতা
ঈশিতা ভাদুড়ী
সেই যে সেই কবে কতদিন আগে ‘যুদ্ধ আর শান্তি’ নামে কবিতা লিখেছিলাম আমি, সেই কবিতায় লিখেছিলাম – ‘রক্তাক্ত জনপথে / যুবক কয়টি নৃত্য করে অবিরত, / তারা বলে চলে / ‘আমরা যুদ্ধ চাই’, ‘আমরা শান্তি চাই’।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়কেরা যুদ্ধ চান, আর সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। যুদ্ধ এবং কবিতা দুটি ভিন্ন বিষয়। অথচ কোথাও তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েই গেছে।
যতই মন্দাক্রান্তা সেন ‘যুদ্ধ পরবর্তী কবিতা’-তে লিখুক – ‘এতবার ধ্বংস হয়ে গেছি, দ্যাখো, তবু ধ্বংস অভ্যাস হল না। / আজও এত কষ্ট হয়,ধ্বংস হতে বড় কষ্ট হয়। / প্রত্যেক নিঃশেষ থেকে,দ্যাখো, সে-ই মৃত্যু থেকে উঠে / ফিরে যাচ্ছি জন্মলগ্নে, ফিরে যাচ্ছি প্রাণপণে, / হামাগুড়ি দিয়ে, বুকে হেঁটে। / এতবার, এতবার মরি, দ্যাখো, তবু মৃত্যু বিশ্বাস করি না। / যুদ্ধক্ষেত্রে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে ফিরি মুখ,ঝরামুখ…’, যত আবেগ, যত দুঃখ বুক নিংড়ে আসুক না কেন কবির, তবুও যুদ্ধ হতেই থাকে পৃথিবী জুড়ে। এবং হতেই থাকবে।
সাধারণ মানুষ যুদ্ধ পছন্দ না করলেও রাষ্ট্রনায়কেরা যুদ্ধ থেকে বিরত হতে চান না মোটেই। ক্ষমতার লড়াই, ইগোর লড়াই তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই যে ট্রয় যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা হয়েছিল হোমারের ইলিয়াড, প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের একটি মহাকাব্য! আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের ‘দ্য চার্জ অফ দ্য লাইট ব্রিগেড’ লেখা হয়েছিল, ক্রিমিয়ান যুদ্ধের একটি কবিতা! সেই যে রূপার্ট ব্রুক লিখলেন ‘দ্য সোলজার’, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি দেশাত্মবোধক কবিতা! কিন্তু এরপরেও কী আমরা শিখলাম যুদ্ধ থামাতে!
এই যে দিনের পর দিন ইরাকে যুদ্ধ হয়, আর সেই যুদ্ধের ফলে কত কবিতার জন্ম হয়েছে! আমেরিকান কবি ব্রায়ান টার্নার লিখেছিলেন ‘হিয়ার, বুলেট’ (Here, Bullet), যেখানে লিখেছিলেন ‘যদি একটি দেহ, যা তুমি চাও, / তাহলে এখানে পড়ে আছে অস্থি-গ্রন্থি, আর হাড়-মাস’। এই কবিতার নামে তাঁর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়, বইটি অসংখ্য পুরষ্কার জিতেছে যার মধ্যে রয়েছে বিট্রিস হাওলি পুরস্কার, নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া পুরস্কার ইত্যাদি। এরিকা রেনি ল্যান্ড হলেন একবিংশ শতকের একজন আমেরিকান কবি, ২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল অবধি ইরাকের মসুলে ছিলেন, এবং তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে দুটি কবিতা সংকলনও প্রকাশ করেছেন। তারপরেও যুদ্ধ থামল কী!
বৃটিশ কবি সিগফ্রাইড লোরাইন সাসুন (Siegfried Loraine Sassoon) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় অনেক রাগী কবিতা লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সুইসাইড ইন দ্য ট্রেঞ্চেস’ (Suicide In The Trenches), সেই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন – ‘আমি একজন সরল সৈনিক ছেলেকে চিনতাম / যে জীবনের দিকে তাকিয়ে খালি আনন্দে হাসত, / একাকী অন্ধকারে নিশ্চিন্তে ঘুমাত…’
১৮৫৪ সালে যুক্তরাজ্য যখন ক্রিমিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন আলফ্রেড লর্ড টেনিসন বিভিন্ন ছদ্মনামে অনেক দেশাত্মবোধক কবিতা লেখেন। বালাক্লাভার যুদ্ধে অশ্বারোহী লাইট ব্রিগেডের দুরবস্থা ও বহু হতাহতের ঘটনার পর টেনিসন ‘দ্য চার্জ অফ দ্য লাইট ব্রিগেড’ কবিতাটি লিখেছিলেন। তিনি লাইট ব্রিগেডের মাধ্যমে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বয়স্ক অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের কীরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা তুলে ধরেছিলেন – ‘অর্ধেক লীগ, অর্ধেক লীগ, / অর্ধেক লীগ এগিয়ে, / সবাই মিলে মৃত্যু উপত্যকায় / ছয়শো লোকের উপর চড়ে…’
যুদ্ধ এবং কবিতা একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও, যুদ্ধ-বিষয়ক কবিতাগুলিতে কবিরা শোক, রাগ, হতাশা, সমস্ত আবেগ দিয়ে লেখেন, যুদ্ধের কবিতাগুলি শুধুমাত্র তো যুদ্ধের বর্ণনা দেয় না, যেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা বিবৃত করেও শান্তির কথা বলা হয়, মানুষের বিবেক ও চেতনা জাগ্রত করার জন্যে। তবুও যুদ্ধ থামে না।
২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ তো একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, যেখানে যুদ্ধের কবিতা প্রতিরোধ, স্মৃতিচারণ এবং প্রতিফলনের একটি শক্তিশালী রূপ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে ইউক্রেনের কবিরা যে ট্রমা ও সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন, এবং তাঁদের যে জাতীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয়, সেই সব প্রকাশের জন্য তাঁরা কবিতাকেই বেছে নিয়েছেন। এইসব কবিতা নিয়ে একটি বিখ্যাত কবিতা-সংকলন হয়েছে ইংরেজি অনুবাদে - Words for War: New Poems from Ukraine, কবিরা সেখানে ক্ষতির কথা বলেছেন, ধ্বংসের কথা, শোকের কথা বলেছেন। ইউক্রেনের বাইরের কবিরাও এই যুদ্ধের প্রতিরোধে লিখেছেন।
‘শুধুমাত্র তোপধ্বনির লোভে?’ কবিতায় প্রশ্ন করেছিলাম – ‘সারারাত নিরলস যুদ্ধের শেষেও / খসড়া কিছুমাত্র বদল না হয় যদি / তবে কেন রাতভোর / রক্ত মাখে অসংখ্যেয় তরবারি? / কেন এই অসামান্য ভুলভ্রান্তি / করে যুদ্ধজিতের দল? / কোনও পিশাচ-সুলভ উল্লাসে? / অথবা, শুধুমাত্র একটি বিজয়পতাকা, আর, / কিছু তোপধ্বনির লোভে?’
কে দেবে উত্তর? রাষ্ট্রনায়করা তো যুদ্ধ চালিয়েই যায়। এবং যুদ্ধ-পরবর্তী কবিতা লেখে কবিরা। সেই কবিতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং শান্তির পক্ষে কথা বলে। তারপরেও যুদ্ধ হয়। সাধারণ মানুষ ধ্বংসযজ্ঞে শেষ হয়ে যায়। এভাবেই যুদ্ধ ও কবিতা পরস্পর-বিরোধী হয়েও পাশাপাশি থেকে যাবে।

বড়ু চন্ডীদাসের স্মৃতিধন্য বাঁকুড়ার ছাতনা রাজবাড়ির দুর্গা পুজো
সোমালি চৌধুরী
প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও শৈল্পিক কারুকার্যে জমিদার বা রাজবাড়ীর ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। কালের সাক্ষীস্বরূপ এমনই এক রাজবাড়ী হল বাঁকুড়ার ছাতনার রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির সাথে বাংলাসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিজড়িত। এই রাজবাড়ির কূলদেবতা হলেন দেবী বাসুলী এবং সেই দেবীর পুরোহিত ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম রত্ন ভূমিপুত্র চারণকবি, বড়ু চন্ডীদাস।
কথিত আছে, সামন্তভূম ছাতনা এবং মল্লভূম বিষ্ণুপুরের মধ্যে বিবাদ ছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস কে ঘিরে। তবে এই বিবাদ এক দৈব বাণীর দ্বারা মীমাংসিত হয় বলে জানা যায়। সেই দৈববাণী অনুযায়ী সামন্তভূমের কূলদেবী মা বাসুলি এবং মল্লভূমের কূলদেবী মা মৃণ্ময়ী। সেই সময় থেকেই (প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের বেশি সময়) বিষ্ণুপুরী আদলে ছাতনা রাজবাড়ীতে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। এই রাজবাড়ীর সাথে আজ রাজাও বর্তমান; বর্তমান বংশধর প্রদীপ সিংহ দেও নিজের হাতেই মায়ের পূজো করে থাকেন।
ছাতনা রাজবাড়ীতে মায়ের পুজো শুরু হয় জীতাষ্টমীর দিন, অর্থাৎ সপ্তমীর পনের দিন আগে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যেখানে সবজায়গায় পুজোশেষে মা বিদায় নেন বিজয়াদশমী তে সেখানে এই রাজবাড়ীর পূজোয় দশমীতে ঘট বিসর্জন হলেও মাকে বিদায় জানানো হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন।
জীতাষষ্ঠীর দিন রাত্রে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীর তৃতীয় বোধন হয় তোপধ্বনির দ্বারা। ছাতনা রাজবাড়ীর পুজোয় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই পূজোয় একমাত্র রাজাই মহাষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি দেন। নিয়মানুযায়ী রাজা ছাড়া পরিবারের অন্য কোন সদস্য দেবীকে অঞ্জলি দিতে পারেন না। সন্ধিপুজোতেও তোপধ্বনি করা হয় এই পুজোয়।
এই রাজবাড়ির পূজোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, পূজোর শুরুতে পরিবারের প্রধানের নাম ও পুজোর সাল একটি নতুন কাপড়ে লিখে মায়ের পায়ে রাখা হয়। পরে পুজো শেষে ওই নাম লেখা কাপড় পূর্বপুরুষদের নাম লেখা কাপড়ের সঙ্গে এক জায়গায় বেঁধে রাখা হয়। নবমীতে পাঠাবলির রেওয়াজ আছে বলে জানান প্রদীপ সিংহ দেও।
ছাতনা রাজবাড়ীর পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ‘ডালা দৌড়’ এবং ‘খাঁড়া দৌড়’। সন্ধিপুজোর সময় আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা ডালা ভর্তি নৈবেদ্য সাজিয়ে সকলে প্রায় দৌড়ে আসতেন নিবেদনের উদ্দেশ্যে যা ডালা দৌড় নামে পরিচিত। অন্যদিকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজপুরুষদের তরবারি, ছুরি,ঢাল ইত্যাদি নিয়ে বাসিন্দারা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যান এবং বিসর্জনের পর সেই অস্ত্র হাতে মায়ের মন্দিরে দৌড়ে যান যা খাঁড়া দৌড় নামে পরিচিত।
রাজবাড়ীর দেবীর বিসর্জনের একটি অভিনবত্ব আছে। দশমীতে নবপত্রিকার বিসর্জন হয় সামন্তদের অস্ত্রসজ্জিত হয়ে। রাতে ছাতনা দুবরাজপুরের বাগদী পাড়ার মানুষজন নিঃশব্দে মাকে নিয়ে যান অন্য জায়গায়; কারণ বিসর্জনের দৃশ্য দেখার নিয়ম নেই কারোরই এমনকি রাজপরিবারের সদস্যদেরও। পরের বছর মায়ের কাঠামোতে তৈরি হয়, মা মনসার মূর্তি। সকলের শান্তি কামনায় দশমীর পূজোর পর রাজা স্বয়ং বাসুলী মায়ের মন্দিরে পুজো দেন। কার্যতঃ লোক চক্ষুর অন্তরালেই দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়। প্রাচীন এই রাজবাড়ীর পুজোয় আজও সেই নিয়ম অক্ষুন্ন ও অটুট রয়েছে।

দুরন্ত শৈশব
শিবানী চ্যাটার্জী
একবিংশ শতকের চরম শিখরে দাঁড়িয়ে আজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষার ঝুলি।
দেবে আমায় ভিক্ষে??
কি চাও বন্ধু??
প্রশ্নের উত্তর একটাই "শৈশব"। সবকিছু আজ ঊর্ধ্বসীমা ছুঁয়েছে শুধু নিম্নমুখী হয়েছে জীবনের একটা সোনালী অধ্যায় তা হলো শৈশব।
শিশুর জন্মগ্ৰহণের পর থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে একটু একটু করে কুড়িয়ে নেয় নুড়ি জীবনের ঝুলিতে । প্রথমত তাদের যাকিছু আচার আচরণ সবকিছু দেখে শুনে রপ্ত। ডাকতে শেখে, বলতে শেখে সবকিছুর পেছনে যেন সেই বেদের বাক্যের মতো। যার জন্য বেদের অপর নাম শ্রুতি বলে থাকি আজও। শিশুরাও ঠিক একটু একটু করে দেখে বুঝে শুনে শিখতে শুরু করে। ক্রমশঃ হাত ধরে দাঁড়ানো, হামাগুড়ি,হাঁটি হাঁটি পা পা, তারপর যখন পায়ে জোর এলো তখন নিজেই দাঁড়াতে শিখে যায়, তারপর কখন যেন শৈশবের সেই দুরন্তপনার মধ্য দিয়ে ছুটতে শুরু করে কোনকিছুকে ছুঁয়ে দেখার জন্য, পাওয়ার জন্য, স্বাদ নেবার জন্য,খুশি থাকার জন্য আবার না পাবার দুঃখে চোখে জলও গড়িয়ে পড়ে।
একটি শিশুর এই বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সবথেকে মূল্যবান সময় হলো এই সোনালী শৈশব। কারণ সোনার মতোই মূল্যবান জীবনের এই অধ্যায়। এখান থেকেই বাকি জীবনের পথ চলার শিক্ষা অর্জিত হয়।
শৈশব মানেই সেখানে থাকবে শিশুর অবুঝ সহজ সরলতা।কেন হলো ,কেন হবেনা সে জানে না। তবুও তার জানার ইচ্ছে প্রবল। কোন কিছু তার সামনে রাখলে তা গরম না ঠান্ডা সে কিন্তু বোঝে না,চায় ধরতে। মা তখন সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য বলে ধরতে নেই। এই সময়ে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকাশের সাথে সাথে মনের বিকাশ শুরু হয় সমানভাবে।
তাদের প্রতিটি মুহূর্ত লক্ষ্য রাখতে হবে। শাসন অনুশাসন সবকিছুর মূলে কিন্তু স্নেহ আদর তাদের অধিকার।
বর্তমান শৈশবের সাথে আমাদের শৈশবের আকাশ পাতাল তফাৎ। সেই শৈশব মানে ছিল উন্মুক্ত আকাশ,খোলা মাঠ, দীঘির জল, গাছে ওঠা, ক্রিকেট ব্যাট বল নিয়ে মাঠে ছক্বা,
সাঁতরে এপার থেকে ওপার যতক্ষণ দম আছে, ডাংগুলি খেলা,আর মেয়েদের ঘরে বসে সেই ঘর সাজানোর পুতুল খেলা আর রান্নাবাটি।
আমিও এই পুতুল খেলা আর রান্নাবাটির জন্য মরিয়া হয়ে যেতাম।সময় গতিশীল, এগিয়ে গেছে অনেকটা দূর। আধুনিকতার চরম সীমায় পৌঁছে আজ শৈশব শুধু পিছিয়ে পড়ল আকার অবয়বের মধ্য দিয়ে।
আমরা কি তাহলে অনুকরণপ্রিয়?? প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তর নেই কোন।
উষাকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে একটু খেয়ে পড়তে বসা। সময় হলে স্নান সেরে স্কুলের পথে। স্কুলের শিক্ষক মহাশয়দের শাসন ও শিক্ষার ধারাবাহিকতায় আমরা ভুল কিছু শিখি নি। যেটুকু শিখেছি আজ সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত সেটুকু নিয়েই। নেই অভিযোগ,নেই দ্বন্দ্ব,নেই হিংসা। স্কুল ফেরত মানেই সেই দুষ্টুমি, চঞ্চলতা, ধুলোমাখা জামাপ্যান্ট,মায়ের বকুনি সবকিছু মিলিমিশে একাকার। এসে পেটমোটা করে খেয়ে একটু ঘুম, নাহলে পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা আড্ডার পর সময়ে বাড়ি ঢোকা। মায়েদের তুলসী তলায় প্রদীপের আলো জ্বালানো মানেই হাতমুখ ধুয়ে এসে পড়তে বসা। রুটিন মাফিক এক শৈশব। বিদ্যুৎ হয়তো কেউ পেয়েছে বা পায়নি। হ্যারিকেনের আলোকে ভাগ বাটোয়ারা করে নিজের পড়া টুকু তৈরী করা। তার মাঝেই চলত নানা খুনসুটি। পরিবারগুলো ছিল আলোময়। দাদু,ঠাকুমা, জেঠিমা,কাকিমা, সবার হাঁক ডাক শাসন ভালোবাসায় কখন যেন বড়ো হয়ে গেছিলাম।
মেলাতে পারিনা সেই শৈশবের সাথে আজকের বাচ্চাদের শৈশব। ভুলটা কোথায়? কার? আমাদের??
নাকি যুগস্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষজনের?? কখনো ভাবি ঠিক কোনটা? আগের নাকি বর্তমান??
সবথেকে বড়ো বিষয় হলো সবকিছুর উন্নয়ন হলেও মানুষের গন্ডী খুব সীমিত ও ছোট হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ আজ উদারতার অভাববোধ। একটা রুটি ভাগ করে খাবার মধ্যে যে আনন্দ ছিল,এক থালায় ভাত মেখে খাবার যে আনন্দ ছিল আজ তা নেই। এখন মনের মাঝে শুধুই অন্তর্দ্বন্দ্ব। ভেঙেছে পরিবার, ভাঙছে সম্পর্ক।
হারিয়েছে বিশ্বাস,ভরসা। সাবেকীয়ানা চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে যে মানসিক উন্নতি বাচ্চাদের মধ্যে গড়ে উঠত আজ তা সংকীর্ণতার পথে। নিউক্লিয়ার পরিবারে বাবা আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ওদের।
ওদের নিজের একটা জগৎ আছে সেটা ওরা জানে না।
আজকের বাবা মাও সেটা চায় না তাদের জানাতে বা সুযোগ দিতে। সামাজিক
হতে গেলে মানুষের সাথে মিশতে হবে ,মেশার সুযোগ দিতে হবে। না , তাদেরকে চার দেওয়ালের গন্ডীতেই
মানুষ হতে হবে।এই দায়বদ্ধতা ওদের কাছে আজ নীলকন্ঠ পানের সমান। জ্ঞান হতে না হতেই প্লে স্কুল, তারপর নার্সারিতে , ইংলিশ মিডিয়াম নাহলে ছেলেমেয়ে মানুষ হবে না।তারপর শুরু হয়ে যায় যুদ্ধযাত্রা। যে শিশু
মায়ের আঁচল ধরে ঘুমোবার বয়স , মায়ের গলা জড়িয়ে গল্প শোনার বয়স সেই শিশুকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিচ্ছি আজকের দুনিয়ায় জ্ঞান সম্পন্ন মানুষজন। তৈরি করতে চাইছি ক্লাসের ফার্স্ট বয় গার্ল। একস্ট্রা কারিকুলামে সবকিছু তার নখদর্পণে থাকতে হবে। বেশিরভাগ বাবা মা একবার ও কি ভাবেন না ওর মস্তিষ্ক কি করে এত বোঝা নেবে?? পিঠের বোঝা ভারী হলেও চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্কুলের দরজায় পৌঁছে গেলেও শিশুর মস্তিষ্ক এই বোঝা কতদিন টানতে পারবে
তা কিন্তু চিন্তার মধ্যে থাকে না। ফলশ্রুতি শৈশব গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে কোন এক অজানা বিপদ শঙ্কায়। কেন আমরা ফিরিয়ে দিতে চাইছি না তাদের শৈশব!!
প্রসঙ্গত,
"শৈশব হলো একটি নিখুঁত সময়, যেখানে আমরা জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং আমাদের চিন্তা মুক্ত হয়।"
----- আলবার্ট আইনস্টাইন।
"যদি আমাদের শৈশব না থাকত তবে আমরা পৃথিবীকে
এত ভালবাসতে পারতাম না।"
------ জর্জ এলিয়ট।
--শৈশব জীবনের এমন এক অধ্যায় যার মূল্য আমার মনে হয় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
--"শৈশব হলো আমাদের মনের নির্জন জায়গা যেখানে শুধুই খেলা আর হাসি থাকে।"
-- "শৈশবের সেই দিনগুলো, যখন দুঃখ বলতে কেবল খেলনা ভাঙা বুঝতাম, আর আনন্দ ছিল একটা ছোট্ট চকোলেট পেলেই। জীবন তখন অনেক সহজ ও সুন্দর ছিল।"
-- "শৈশবের সেই খেলার মাঠ
এখনো মনে পড়ে, সেখানে শুধু হাসি আর গল্প।"
-- "শৈশব মানেই দুষ্টুমি আর টুকিটাকি নির্ভেজাল আনন্দ,
টাকাপয়সা নয়, ছোট ছোট মুহূর্তগুলো ছিল আমাদের আসল সুখ।"
সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে অনেককিছু। বাঁধনহারা আনন্দ খুশির মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কোন অংশেই কমে যায় না বরং
বাড়ে। আজকের দিনে মেডিকেল শাস্ত্র অনুযায়ী মনকে খুশি রাখার জন্য "লাফিং ক্লাবে " মানুষ সময় কাটাচ্ছে। সবকিছু থাকার পরেও কিছু যেন নেই। উদাস মন নিয়ে প্রতিটি ঘরের দরজায় আজ মানসিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। যেই সময়টা খোলা আকাশের নীচে থাকার কথা তখন তাকে সমাধান করতে হচ্ছে জটিল অঙ্কের। হয়তো চাপে পড়ে করছে। কিন্তু ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার চেষ্টা অধ্যবসায় এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা।
জানালায় পা ঝুলিয়ে দুলে দুলে সেই ছড়া বলা আজ কোথায় গেল? বৃষ্টিতে কাগজের নৌকা ভাসাতে গিয়ে ভিজে যাওয়া, অমল ও দই ওয়ালার গল্প সেই জানালায় বসে চেয়ে থাকা
এগুলো কি ভুল ছিল?? তাহলে তো আমরাও বিপরীত কিছু হতে পারতাম। তখনকার শিক্ষা পেয়েও বিপরীত কিছু ভাবতে পারছি না আজকের দিনে।
শৈশবকে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করুন প্রতিটি বাড়ির বাবা মা। ওদের মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারবেন যখন ওদেরকে মনের মতো করে শৈশবের সময় অতিবাহিত করতে দেবেন।
এরজন্য বাবা এবং মা দুজনকেই জীবনে সংযমী হতে হবে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মাষ্টারদা সূর্যসেন,
চিত্তরঞ্জন দাস আমাদের দেশ ভারতবর্ষের সন্তান। তখন বাবা মার শিক্ষায় আজ তারা
পথ প্রদর্শক আমাদের।
শিশুদের মধ্যে কান্না হাসির দোদুল দোলা এতো প্রকৃতির সৃষ্টি। ওরা হাসবে কাঁদবে ঘুমোবে এর মধ্যেই চিনবে অক্ষর, শব্দ, বাক্য তৈরি।
চাপ দিয়ে নয়। ওদের মতো করে ওরা শিখুক। আমাদের পাশে থাকতে হবে। প্রতিযোগিতায় নামিয়ে ওদের
বুদ্ধির বিকাশ ঘটার পরিবর্তে
নির্বুদ্ধি তৈরী করে ফেলছি মনে হয়। ওদের মধ্যে সরলতা খুঁজে বার করুন। তুলে ধরুন ছোট ছোট গল্প কবিতার মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবন চলনা। মনীষীদের উদ্ধৃতি তাদের জীবনী বলুন।
তাদের শেখান রীতিনীতি সংস্কার। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। তাদের খাদ্যাভ্যাসের দিকেও নজর রাখতে হবে সুস্থতার জন্য।
ওদের মাঠে খেলতে দিন,
সামাজিকবোধ গড়ে তুলতে
বিবেক বুদ্ধিকে জাগ্ৰত করতে হবে। হিংসা স্বার্থ
এসব থেকে ওরা যেন দূরে থাকে। ওদের মানবিক করে তুলতে হবে। শৈশবের সঠিক শিক্ষা যদি দেওয়া যায় সেই সন্তান কোনদিন খারাপ হতে পারে না।
আজকের দিনে এই শৈশবকে কেড়ে নেবার জন্য
শিশুদের উদ্ধত আচরণ লক্ষ্য করা যায়। হারিয়ে ফেলছে শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা। বর্তমান দুনিয়ায় তাদের চার দেওয়ালে বন্দী থাকার জন্য
তাদের বন্ধু এখন মুঠোফোন।
ফলে লেখাপড়ার ঘোড়দৌড়ের সাথে ছুটতে ছুটতে তাঁরা হাঁফিয়ে উঠেছে।
সময় কাটাতে চায় শুধু মুঠোফোনে। সারাদিন গেম খেলতে চায়। দৈহিক কার্যকলাপ বন্ধ। তাই
শরীর মন কোনোটাই তাদের সঠিক তৈরি হচ্ছে না। আজকের দিনে ছেলেমেয়ের শৈশবের অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
সুইসাইডাল টেনডেন্সি ,মুড সুইং, ডিপ্রেশন এসব শব্দগুলো আজ বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত জীবাণুর মতো। কেন হচ্ছে ,কারণ খুঁজে বার করুন। শৈশবের হাসি ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হন
সকলে শিশুদের।জানি, বলা যতটা সহজ ,ভাবনায় হয়তো অনেক কঠিন। কিন্তু শুরু না করলে আগামীতে এক ভয়ঙ্কর রূপরেখা টেনে দিয়ে যাব আমরাই নিজ হাতে। তাই আজ ভিক্ষার ঝুলি হাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি শিশুদের মনের মতো গড়ে তুলতে হলে ওদের শৈশব ফিরিয়ে দিন, ফিরিয়ে দিন ওদের একমুখ হাসি, দুরন্ত শৈশবে বেড়ে ওঠার সুযোগটুকু।
Copyright © 2025 আক্ষরিক - All Rights Reserved.
Powered by GoDaddy
We use cookies to analyze website traffic and optimize your website experience. By accepting our use of cookies, your data will be aggregated with all other user data.