
তালারাম ও কিরন দারোগা।
তরুণ চট্টোপাধ্যায়।
তালারাম কে চেনে না এ তল্লাটে এমন মানুষ একজনও নেই।সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে তালারাম একজন নিপুন শিল্পী ।ওর হাতের কেরামতিতে যত মজবুত তালা হোক না কেন তালা খুলে যাবেই।কোন চাবির দরকার হবে না। ও যেন মন্ত জানে।গৃহস্থের দরজায় দাঁড়িয়ে নাকি তালি দেয় ।আর তালা চিচিং ফাঁক।না কেউ দেখিনি অবশ্য ।তবে এলাকার দশটি গ্রামেই এই কথাটি ছড়িয়ে গেছে।তালারামের কাছে তালা খোলা নাকি জলভাত।আর এই কেরামতি নিয়ে সে গ্রামের বাড়িতে তালা খুলে চুরি করে অনায়াসে।আসলে সে এক মস্ত চোর।তাই গৃহস্থ ওর ভয়ে কাঁটা।কিন্তু মন্ত তন্ত্র জানে তালারাম এই ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করে না।তালারাম অবশ্য চুরি করলেও ওর প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিষ সে কখনো নেয় না।বেছে বেছে তালারাম যা চুরি করে তা গৃহস্থের কাছে খুবই নগন্য।মাথার কাঁটা চুলের ফিঁতে সাজবার সরঞ্জাম ।কখনো সখনো দু একটি দামী শাড়ী।গহনা নিলেও তা ইমিটেশন।টাকা আর সোনার দিকে সে কখনোই নজর দেয় না।বলে মানুষ কত কষ্ট করে এসব করে।আমি কেন খামোকা এসব নেব।আমার প্রয়োজন কি আছে। দরকার ছাড়া কোন জিনিস তালারাম চুরি করে না।ওর সাফ জবাব আমি চুরি করি আমার জন্য নয়।আমি একা মানুষ আমার কি আর লাগে।বাপের জমি জিরেত চাষ করে আমার চলে যায়।আর সাজবার জিনিস তো পায়েল কে দিয়ে আসি।মেয়ে টি বড় গরীব ।কিন্তু সাজতে ভালবাসে।তাইতো রাতেই চুরির পর ওর জানলায় রেখে আসি।সকালে পায়েল সব নিয়ে নেয় ।পায়েল অবশ্য জানে তালারামের কথা।ভাব করতেও ইচ্ছে করে।কিন্তু পায়েলের বাবা চৌকিদার গ্রামের ।বাবা চোর তালারাম কে কখনোই মেনে নেবে না তা পায়েল জানে।তাই মন খুলে মিশতে পারে না তালারামের সঙ্গে ।যে টুকু ভাব ভালবাসা তা আকার ইঙ্গিতের ।আর তালারাম এসব জেনেও পায়েল কে খুশি রাখতে এসব চুরি করেই যোগান দেয় ।ভালবাসা বলে কথা।সে কি আর চুরি না করে থাকা যায় ।
তালারাম অবশ্য এমন মানুষ ছিল না।চুরি তো দূরের কথা।মিথ্যা কথাও সে কখনো বলেনি এতদিন।তালারামের বাবা সখ করে বিয়ে দিয়েছিল ভিন গ্রামের এক সুন্দরী মহিলার সঙ্গে ।বেশ কাটছিল তালারামের জীবন।দিনে জমিতে চাষাবাদ ।আর রাতে বাড়ি তে বসে নতূন বৌ এর সঙ্গে ঠাট্টা তামাসা।যেমন হয় আর কি।সব নতূন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে । তালারামের জীবনেও সেই একই গল্প ।একটি সুখী পরিবারের ছবি।দিন এগিয়ে যাচ্ছিল তরতরিয়ে ।দিনযাপনের বিধিলিপি মেনেই।কিন্তু মানুষ ভাবে এক ঈশ্বর করেন আর এক।আর সেটিকেই আমরা বলি বিধিলিপি ।
বেশতো ছিল দুজনেই ।হঠাত্ কানা ঘুমোয় শোনা গেল তালারামের বৌ কে নাকি ডাইন ভর করেছে।অমাবস্যার রাতে গ্রামের মানুষ তাকে দেখেছে জলা জঙ্গলে ঘুরতে।প্রথমে সে কথা বিশ্বাস করেনি ।কারন এমন সুন্দর বৌ ডাইন হতে যাবে কেন।কিন্তু একদিন রাতে সে নিজেই দেখে বৌ বিছানা ছেড়ে সত্যিই বেরিয়ে যাচ্ছে ।আর সে রাতেও ছিল অমাবস্যার রাত।
লুকিয়ে পিছু নিল তালারাম চুপিসারে।কিন্তু যা দেখলো তা বর্ণনার অতীত।সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তালারামের বৌ মুখে জলন্ত প্রদীপ নিয়ে বনে জঙ্গলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ।আর মাঝে মাঝে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে মরে যাওয়া চাঁদের আলো খাচ্ছে।আর অন্ধকার আরো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ।
নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাসের চোখে দেখা যায় না ।তাই ফিরে আসে সে।আর ভোর রাতে ফিরে আসে তালারামের বৌ।
এর পর থেকে শুরু হয় তালারামের বিবাহিত জীবনে খিটিমিটি।সেই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে মহীরুহতে পরিনত হতে সময় বেশি লাগে না।একসময় ওর সংসার ভাঙে।আর বৌ যে কোথায় চলে যায় তা তালারাম জানতে পারেনি।
আসলে তালারাম নামটি তার কখনোই ছিল না।বাপ মায়ের দেওয়া নাম নিয়েই তালারাম আর পাঁচজনের মতোই বেড়ে উঠছিল।কিন্তু ওর তালাভাঙার কেরামতি থেকেই যে ওর নাম তালারাম হয়েছিল সে কথা সকলের জানা।কিন্তু সকলেই ওকে তালারাম নামে ডাকতে ডাকতে কবে যে সে তালারাম হয়ে গেলো সে কথা ওর মনে নেই।আজ অবশ্য বাপ মায়ের দেওয়া নামটি তালারামের মনে নেই।নিজের অজান্তেই সে যে তালারাম হয়ে উঠেছে শুধু এটুকুই জানা।
বৌ কে যে সে খোঁজে নি তা কিন্তু নয়।বনে জঙ্গলে আদাড়ে বাদাড়ে অনেক খুঁজেছিল সে বৌ কে।কিন্তু ডাইন মহিলা কবে কোথায় কার হাত ধরে বেরিয়ে গিসলো সে সন্ধান আজও পাইনি তালারাম।আর পাবেই বা কি করে।অলৌকিক আত্ম যার ওপর ভর করে তাকে কি চারদেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায় ।সে তো তখন চরাচর জুড়ে চাঁদের আলো খায়।জোনাকির পিছে পিছে ঘোরে।গাছ থেকে ফুল পেড়ে বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে মধু চুষে নেয় এক লহমায় ।আর রাত বিরেতে পথ ভোলা মানুষ পেলে ঘাঁড় মটকে রক্ত ও খায়।তাই আর চেষ্টা করেনি তালারাম।ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে।
অবশ্য পায়েলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পরিবর্তন আসে জীবনে।একটু একটু করে স্বপ্ন দেখা শুরু।আর পায়েল কে খুশি করতেই ওর এই নতূন জীবনে পা দেওয়া ।সব ভুলে পায়েলকে পাওয়ার লোভ ওকে তালারামে পরিনত করে।চুরির শুরু সেই থেকেই।চাই চাই।পায়েলের মাথার কাঁটা নেলপালিশ সময়ে সময়ে দামী শাড়ি।আরও কত কি।যা দিয়ে পায়েল নিজেকে সাজাতে পারে।আর তা দূর থেকে দেখেই তালারামের সুখ।
না কাছে যেতে সত্যি ভয় ছিল তালারামের।চৌকিদার বাবা যখন রাতের অন্ধকারে হূ কামস্ দেয়ার কথাটি নিজ উচ্চারণে হুকুমদো বলে চিৎকার করতো সত্যই বুক কাঁপতে তালারামের । জাগতে রহো কানে শুনেই তালারাম ছুট দিতো জঙ্গলে ।সেদিন আর কারো ঘরে তালা ভাঙার সাহস হতো না তার।আর পায়েলের সঙ্গে দেখা সে রাতে হতোই না।পুলিশের মতো খাঁকি জামা আর লন্ঠন হাতে পায়েলের বাবাকে সাক্ষাত যমই ভাবতো তালারাম।তবে সব ভয়কে জয় করেও মাঝে মাঝেই গেরস্থালির তালা ভাঙতে সে।সে অবশ্যই পাওয়েলকে সুখী করতেই।কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও পায়েল তালারামের ঘরে বৌ হয়ে আসার সাহস পেতো না।বাবা চৌকিদার ।সে কি মেনে নেবে এমন চোর জামাইকে।তাই মহাগোপনেই চলছিল পায়েল আর তালারামের প্রেম পর্ব ।
একদিন তালারাম জানলো পায়েলের সখ হয়েছে ডাক্তার রবী বেরার মেয়ে কুসুমকলির মতো সাজতে। মেয়েটি নাকি কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছে।আর আসার সময় তিন বাক্স ভর্তি সাজার সরঞ্জাম এনেছে।রোজ বিকালে আলাদা আলাদা সাজে বিকালে ঘুরতে বেরোয় ।সে দৃশ্য নাকি চোখে পড়েছে পায়েলের।আর যায় কোথা।তালারামের কাছে রাতের অন্ধকারে বায়না ধরে পায়েল।এই সাজ ওর চাই।
কিন্তু তালারাম সব ঘরের তালা ভাঙলেও রবী বেরার চৌহদ্দী তে কখনোই যায় নি।তার কারন অবশ্য ডাক্তারের জার্মান শেপার্ড টি।এমন কুকুর তালারাম জীবনে দেখেনি।যেমন লম্বা তেমনি হাঁকডাক।পাড়ার ছেলেরা কুকুরের ভয়ে ডাক্তারের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটে না।আর তালারাম নাকি সে বাড়ি তে ঢুকবে চুরি করতে।কিন্তু প্রেম বড় দায়।ভালবাসার মানুষকে কাছে পেতে কে না চায় আর তালারামতো পায়েলের ভালবাসায় অন্ধ।
না সেই ডাক্তারের বাড়ির মধ্যে ও তালারাম ঢুকেছিল।আর শুধু ঢোকা কেন ।কুসুমকলির সমস্তই সাজের বাক্স পৌঁছে দিয়ে ছিলো পায়েলের জানলায়।আর তা পেয়ে পায়েল হয়েছিল মহা খুশী।জানলা দিয়ে আলতো করে তালারামের হাত ছুঁয়ে বলেছিল আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।দেখো বাবাকে ঠিক রাজি করাবো।
তালারাম যে অনায়াসে তালা ভাঙে তা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলতো।কেউ কেউ বিশ্বাস করতো তালারামের বৌ নাকি তালারামকে তালা খোলার তন্ত্র শিখিয়ে গিসলো ঘর ছাড়ার আগে।আবার কেউ বলতো বৌ চলে যাবার পর তালারাম যখন বনে জঙ্গলে ঘুরতো তখন নাকি কামাখ্যার এক সাধুর সঙ্গে আলাপ হয়।সেই নাকি তালারাম কে খুশি হয়ে এই বিদ্যা শেখায়।আবার এক দলের অভিমত তালারাম কিছুদিন শহরে গিয়ে তালাওলাদের কাছ থেকে এ বিদ্যা শিখে আসে।আসল কারন কিন্তু কেউ জানতো না।সবাই অনুমানের ওপর ভর করেই চলতো।আর সেই কাহিনী এলাকার মানুষের মুখে মুখে টক ঝাল মিষ্টি হয়েই ঘুরে বেড়াতো।
এদিকে ডাক্তারের ঘরে চুরির কথা থানায় লিপিবদ্ধ হলো।থানায় তখন কিরন দারোগা জয়েন করেছে।দুঁদে দারোগা বললে কম বলা হবে।দারোগা বাবুর কথায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো।রবী বেরা ছুটলো নিজেই থানায় ।কিরন দারোগা ও এল সরেজমিনে তদন্তে।এসেই নজর পড়লো কুকুরটির দিকে।যখন দারোগা শুনলো ডাক্তার বাবুর কুকুর সারাদিনই ছাড়া থাকে তখনতো বিস্ময়ে হতবাক।এ বাড়িতে চোর আসে কোন সাহসে।ডাক্তার বাবুই বললো স্যার এ কাজ তালারাম ই করেছে।আমার সব জিনিস ঠিক আছে।শুধু মেয়ের প্রসাধনী ছাড়া ।আর এই চুরি তালারাম ছাড়া কেউ করবে না।কিরন দারোগা থানায় আসার পর তালারামের সব গল্পই শুনেছিল।ডাইন হয়ে বৌ চলে যাওয়া থেকে পায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ।একদিন তালারামের সঙ্গে দেখা করারও ইচ্ছা ছিল।কিন্তু কাজের চাপে তা হয়ে ওঠেনি।তাই আজই চৌকিদার কে বললো তালারাম কে থানায় নিয়ে আসতে।
চৌকিদার তো বেজায় খুশি।এদিকে পায়েলের কানে খবরটা পৌঁছে গেছে।সে তো চৌকিদার বাবার পা ধরে অনেক কাকুতি মিনতি করলো।কিন্তু দারোগা বাবুর নির্দেশ ।তাতো অমান্যের কোন জায়গা নেই।ফলে চৌকিদার শশুরের হাতে বন্দি হয়ে তালারাম চললো কিরন দারোগার খপ্পরে।আর ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো দারোগার মুখটি মনে ভাসতেই।
কিরন দারোগা তালারামের মুখে আবার সব কিছু শুনে খুশিই হলো।বললো ঠিক আছে তালারাম ।আমি চৌকিদার কে বলে পায়েলের সঙ্গেই তোমার আবার বিয়ের বন্দোবস্ত করে দেব।কিন্তু সর্ত একটাই।তোমাকে বলতে হবে ডাক্তার বাবুর বাড়ি তে চুরি কেমন করে করলে।ওমন কুকুর টিকে তোমার ভয় করলো না।আমার মতো দারোগা যে কুকুর দেখে সাত পা পিছিয়ে আসে।আর তুমি কিনা সেই ঘরের তালা ভাঙলে।
তালারাম বুঝলো সে ধরা পড়ে গেছে।এখন দারোগা বাবুর দয়াতেই তাকে বাঁচতে হবে।আর দারোগা খুশি হলে সে পায়েল কে পেতেও পারে।তাই ভনিতা না করে সরল সত্যি কথাই বলতে শুরু করলো।
দারোগা বাবুর কঠিন চোখ তালারামের দিকে।তালারাম শুরু করলো সেই রাতের কাহিনী ।বললো স্যার আমি তো ডাইন বৌ কে হারিয়ে ঠিক করেছিলাম এ জীবন রাখবো না।পায়েল ই তো আমাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখালো।একটা সামান্য কুকুরের ভয়ে আমি কি হারাতে পারি আমার ভালবাসা ।তাই কদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলাম কি করে কুকুর টাকে ঠকাবো।ভগবান মুখ তুলে চাইলেন।মাথায় বুদ্ধি এসে গেল।
আমি গেটে আসতেই কুকুর টা তেড়ে এলো।আমি গেটের মুখে রাখলাম অনেকখানি মাংস।মাংসের লোভে কুকুরটি যখন মগ্ন তখন কায়দা করে ওর লেজে জড়িয়ে দিলাম অনেকখানি কাপড়।আর তাতে ঢেলে দিলাম পরিমান মতো স্পিরিট।মনের আনন্দে কুকুর মাংস খায় আর লেজ নাড়াচাড়া করে।বুঝলাম ফল মিলেছে।লেজ যত ঠান্ডা হচ্ছে ততই ছটফট শুরু।শেষমেষ ডাক্তার বাবুর পুকুরে সেই যে লেজ ডুবিয়ে বসালো আর ওঠা নেই।আমিও সেই সুযোগে ভাঙলাম তালা।তার পরের কাহিনী তো আপনার জানা স্যার ।
কিরন দারোগা কথা রেখেছিল।চৌকিদার কে রাজি করিয়ে পায়েলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছিল তালারামের।চৌকিদার শশুরও কিরন দারোগার ভয়ে টুঁ শব্দটি না করে তালারামকে জামাই করে ঘরে এনেছিল।
এরপর কেউ যদি জানতে চাও তালারাম ক ফুট লম্বা ছিল।গায়ের রঙ কেমন ছিল।পায়েলের সঙ্গে ভবিষ্যতে বনিবনা হয়েছিল কিনা।এসব আমি বলতে পারবো না।কিরন দারোগা কে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারো।বাকি জীবন কিরন দারোগা আর তালারাম হয়েছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ।এর বেশি আমার জানা নেই।
কিরন দারোগা আর তালারামের সঙ্গে আমার বহুদিন দেখা সাক্ষাত নেই। তবে খোঁজ খবর করে ঠিকানা এনে দিতে পারি।এর বেশি সাহায্য আমার দ্বারা হবে না।সে কথা আগেই বলে রাখলাম।
আজও তালারামের মতো সুনিপুন চুরি ভূভারতে কেউ করেছে বলে শুনিনি।তবে জেনেছি আজ তালারাম ও পায়েল সুখেই সংসার করছে। চুরি সে কাজ আর তালারাম করেনা।সে এখন পায়েলের বর।
চৌকিদারের জামাই।চুরি কি তার সাজে।
আর কিছুই আমি জানি না।বলতেও পারবো না।
তালারাম ও কিরন দারোগা ।
তরুণ চট্টোপাধ্যায় ।

মায়ের জন্মদিন
প্রদীপ মাশ্চরক
আজ আমি সাতানব্বই বছরে পা দিলাম। মেল বক্সে কোনো হ্যাপি বার্থডে কার্ড নেই, কেউ ফোন করে নি। আমার সেই পরিচিত ছোট্ট ঘরে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এক মুদিখানার ওপরের এই ঘরটিতে আমি পঁচিশ বছর ধরে ভাড়া আছি। ভাড়া কম, মালিক ভাড়া বাড়ায়নি কারণ বছর কয়েক আগে বাড়ির সব পুরনো জলের পাইপ আমি সারাই করিয়ে দিয়েছিলাম। ঘরে একটি মাত্র জানলা, এই জানলার ধারে বসে আমি রাস্তার মানুষের চলাচল দেখি। বাস আসে, মানুষ ওঠে, বাস চলে যায়। তাদের সাথে আমার সময়ও চলে যায়।
আজ সকালে আমি গেছিলাম পাড়ার বেকারি শপে। কাউন্টারের মেয়েটা তার নিয়মিত হাসি হেসে খদ্দের সামলাতে লাগলো। আমি যদিও প্রায় প্রতিদিন এই দোকানে গতকালের বাসি পাউরুটি কম দামে কিনতে আসি, মেয়েটি আমায় খুব ভালো করে চেনে না। “আজ আমার জন্মদিন” বলামাত্র সে আমার দিকে তাকিয়ে চটপট উত্তর দিল, “ও, হ্যাপি বার্থডে”। ব্যাস, ওই পর্যন্তই।
আমি একটা ছোট ভ্যানিলা কেক কিনলাম, ওপরে স্ট্রবেরি দিয়ে সাজানো। মেয়েটিকে বললাম, “ওপরে হ্যাপি সাতানব্বই লিখে দাও”। জোরে বলতে একটু লজ্জা লাগলেও নিজেই বললাম।
ঘরে ফিরে এসে আমার একটিমাত্র ভাঙ্গা টেবিলে কেকটি রেখে তার ওপর একটি মোমবাতি জ্বেলে চেয়ারে বসে রইলাম, কার আশায় কে জানে!
আমার একমাত্র ছেলে সুপ্রকাশ অনেক বছর আমাকে ফোন করে না। তার সাথে শেষ কথপোকথন রাগারাগিতে পরিণত হলে সে ফোন কেটে দেয়, আমি তার বউয়ের সম্পর্কে কটু মন্তব্য করেছিলাম। তারপর থেকে কোন যোগাযোগ নেই, আর ওর বর্তমান ঠিকানাও আমি জানি না।
কেকের এক স্লাইস কেটে মুখে দিলাম, তাজা কেকের হাল্কা মিষ্টি স্বাদ মুখ জুড়িয়ে দিলো। তারপর কি ভেবে আমার মুঠোফোনে একটা সেলফি তুলে নিচে “হ্যাপি বার্থডে টু মা” লিখে পাঠিয়ে দিলাম ফোনে ধরে রাখা সুপ্রকাশের নম্বরে।
কতক্ষণ সেই নিঃশব্দ ঘরে অপেক্ষা করেছিলাম ফোনটা বেজে ওঠার আশায় তা মনে নেই। তারপর কোন এক সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আমার জন্মদিন শেষ হয়ে যায়।

চিন্তামণি
শিখর চক্রবর্তী
অবিনাশ তরফদার জীবনে একটি নীতি সামনে রেখে পার করে এসেছেন জীবনের পঁয়তাল্লিশ টা বছর। এ নীতি তার কানে মন্ত্রের মতো দিয়েছিলো তারই ঘনিষ্ঠ বড়ো দাদার মতো বঙ্কিম পুততুন্ড। তা হল নিজের জীবনের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হবে, অন্য কারো পরামর্শ বা উপকার না নিয়ে। এতদিন বুক ঠুকে এভাবেই তিনি জীবনের সব চড়াই উতরাই পার হয়ে এসেছেন।
তবু গত একমাস যাবৎ তার চোখে ঘুম নেই, খিদে নেই, কাজে ভুল হচ্ছে, অফিসে বকা খাচ্ছেন। এ কদিনে ওজন কমেছে, তিন কেজি পাঁচশ গ্রাম। বৌ, মেয়ে, বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছে তার কি হয়েছে, উত্তর দেন নি। সমস্যা গুলো নিয়ে একা গভীর চিন্তা করে গেছেন, তার বোঝা কারুর ঘাড়ে ফেলা যাবে না। বঙ্কিম বারবার বলতো, তিনি এখনও তা থেকে সরে আসেননি।
ডাক্তার এসে প্রেসার দেখে যখন বললো, " বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে রক্তচাপ, ওষুধেও কমছে না, চিন্তা কিছু একটা করেছেন নিশ্চয়ই। এভাবে কিন্তু হার্ট বা সেরিব্রাল এর বিপদ ডেকে আনছেন," তখন একটু ভয়ই পেলেন অবিনাশ। বৌ, মেয়ে ফেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বা ফট করে মরে গেলে সবাই ভেসে যাবে যে।
সে রাতে স্ত্রীর কান্নাকাটি, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনুনয়ের পর আর তিনি পারলেন না। বাঁধ ভেঙে গেল অবিনাশের। তিনি নীতিচ্যুত হলেন। মানসী সব মন দিয়ে শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে, অবিনাশের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ভরসার জোর এনে শুধু বললেন, "সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। কাল ভোরে ছাদে চলে যাবে। টাটকা হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মন হালকা করে সবকিছু নতুন করে একবার ভাববে। যে সমস্যার যা নিদান প্রথমেই মনে আসবে সেটাই করবে। যাদের সঙ্গে আলোচনা করার, জানানোর তাদের বলবে। সমাধান ঠিক বেরিয়ে আসবে।"
অনেকটা হালকা হয়ে অবিনাশ মাথায় চুলের মধ্যে মানসীর আঙুলের নাড়াচাড়া অনুভব করতে করতে যখন চোখ বুজলেন, ঘড়িতে তখন রাত একটা পঁয়ত্রিশ। তবু অনেকদিন পর একটু ঘুমোলেন অবিনাশ।
থানার বড়বাবু নতুন ছেলে। তাকে বিষয়টা বোঝাতে অবশ্য বেগ পেতে হলো না। মেয়ে অনিন্দিতার পেছনে লেগেছে একটি ছেলে। খুব খারাপ, রকবাজ, মার্কামারা ছেলে। বাপ এলাকার রাজনৈতিক নেতা। সেই বাপের কাছে গিয়ে ফিরে অভিযোগ করায় হুমকি খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ছেলেটা এসব জেনে রাস্তায় হুমকি দিয়েছে। মেয়েকে রাস্তায় একবার হাত ধরে টেনেওছে। মেয়ে ভয়ে কলেজ যাওয়া কদিন বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি তারপর পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এটা তো সমাধান নয়। এভাবে আগলে রাখা সম্ভব নয়। থানা পুলিশ করেননি এতদিন যদি ওরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এই ভয়ে। এছাড়াও লোক জানাজানি হয়ে আলোচনার বিষয় হয়ে হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। অথচ আজ ভোরে ছাদে পায়চারি করতে করতে এই পুলিশে আসার কথাটাই প্রথম মনে হয়েছিল। মানসীর কাল রাতের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি দেরী করেননি।
নতুন অফিসার সব শুনে বললেন," আপনার আগেই কমপ্লেন করা উচিত ছিল। এসব ঠান্ডা কি করে করতে হয় সব আমি জানি। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। কিছুদিন সাদা পোশাকে নজর রাখা হবে আপনার মেয়ের ওপর। হাতে নাতে একবার ধরতে চাই। তারপর আমি জানি কি করতে হবে। পলিটিশিয়ান দের ক্ষমতাও আছে, দুর্বলতাও আছে। আপনি একটা ডায়েরি করে রেখে যান।"
পাশের বাড়ির নিত্যানন্দ সরকার কোর্টের মুহুরী। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিবাদ বেরোনোর রাস্তার পাশে পাঁচিল তোলা নিয়ে। তার আপত্তিতে ভিত খুড়েও পাঁচিলের কাজ বন্ধ আজ দেড় বছর। নিত্যানন্দ কেস ঠুকে দিয়েছিলেন। সে শুনানি আজও চলছে, কতদিন চলবে তাও জানেন না। মাঝ থেকে উকিলের পেছনে গোছা গোছা টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। এককালে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
দুগ্গা বলে নিত্যানন্দ র দরজায় বেল টিপেই দিলেন অবিনাশ। এমনটাই আজ সকালে মাথায় এসেছিল তার।
ছুটির দিনে নিত্যানন্দ বাড়িতেই ছিলেন। প্রথমেই ভুরু কোঁচকালেও আস্তে আস্তে সেসব সোজা হয়ে টেবিলে চলে আসলো কফি, পকোড়া।
-- "আরে পাশাপাশি এতো ইগো নিয়ে থাকা যায় নাকি!?" বললেন নিত্যানন্দ, "আপনি জেদ ধরে রেখেছিলেন তাই আমারও জেদ চেপে গেছিলো। এসব কেস কাবারির ঝামেলা কম নাকি? কার আর ভালো লাগে। যাকগে ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন, আলোচনা করছেন। ঠিক আছে আমি আমার সদর একটু সরিয়ে নেবো। আপনি পাঁচিল তুলবেন। একটু তিনফুট ছেড়ে দেবেন তাহলেই হবে। কেস কাল পরশু করে তুলে নেবো।"
অবিনাশের শরীরটা কেমন যেন হালকা ফুরফুরে হয়ে গেল।
বাড়ি গিয়ে ফোনে ধরলেন অফিসের সহকর্মী রতনতনু কে। বললেন সমস্যাটা। বাড়ি তৈরির লোনটা নিয়েছিলেন অফিস থেকে, সেটা সুদে বেড়ে বেড়ে এখন এতো টাকা কাটছে যে মাইনেতে টান পড়ছে। বকেয়া টাকাটা একলপ্তে শোধ করতে পারলে মুক্তি হয়। কিন্তু খোলাবাজারে সুদ আরও বেশি। বড়ো সাহেবকে বলে যদি সুদটা একটু কমানো যায়। রতন ছেলেটা বড়ো ভালো, দাদা দাদা করে, অফিসের আ্যকাউন্টান্ট। সব শুনে হৈ হৈ করে বললো, "আরে দাদা, এসব তো আগে বলবে!! "
কেন যে তিনি বলতে পারেননি তা আর ভাঙ্গলেন না ভাইয়ের মতো সহকর্মীর কাছে।
-- "দাদা, বস এখন আমার ওপর হেবি খুশ আছে। কদিন আগে অনেক টাকার একটা ব্যাঙ্ক লোন কোম্পানির নামে পাশ হয়েছে। আমি খুব খেটেছিলাম। আমি বললে না করবে না বোধহয়। আর না হলেও অসুবিধা নেই। আমার একটা টার্ম ডিপোজিট ম্যাচিওর করবে পরের মাসে। ওটা তো ব্যাঙ্কেই রাখবো ভেবেছিলাম। তুমি না হয় ওটা নিয়ে অফিসের লোন টা শোধ করে দিও। তারপর আমাকে কিস্তিতে শোধ দিও। ব্যাঙ্কের সুদটুকু দিও শুধু অন্ততঃ। কি? চলবে? "
হ্যা হ্যা করে খানিক হাসে রতন। অবিনাশের আবার একইসঙ্গে হাসি আর চোখে জল চলে আসে।
সে রাতে অনেকদিন পর মন খুলে মানসীর সঙ্গে অনেক গল্প করলেন অবিনাশ। দেরিতে ঘুমোলেও শরীর একটুও খারাপ লাগে নি।
থানার বড়োবাবু সেই ছেলেটাকে হাতেনাতে ধরে লক আপে রাখতে দৌড়েছিলো ওর বাপ। সামনে ইলেকশন। এসব কেস খেলে পার্টির বদনাম। পদ হারাতে হবে। অগত্যা সুর নরম। অবিনাশ কে ডেকে মিটমাট করে অভিযোগ তুলে নিতে বলেছেন। আপাতত শান্তি। ছেলেটাও ক্ষমা চেয়েছে।
রতনের কথায় অফিস সুদটা কমিয়ে দিয়েছে। অবশ্য রতন তার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব থেকে সরেনি। বলে রেখেছে, "লাগলেই বলবে, শুধু অনাদির মোগলাই খাইয়ে দিলেই হবে। "
নিত্যানন্দ কেস তুলে নিয়েছে। আবার শালার বিয়ের নেমন্তন্নর কার্ড দিয়ে গেছে বাড়ি এসে।
অবিনাশের এখন প্রেসার নরমাল, ঘুম ঠিকঠাক হয়, ওজন অবশ্য আর বাড়াননি। ওটা থাকাই ভালো, খাওয়া কন্ট্রোল।
একটা নতুন ভাবনা এসেছে কদিন হলো। এ তত্ত্বের, এ নীতির অন্তঃসার শূন্যতা তিনি বুঝেছেন এখন। বরং মানসীই ঠিক। আর একথাটা বঙ্কিমকে জানানো দরকার। যদিও তার কোন খবর , যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। শুনেছিলেন ছেলের কাছে আসানসোলে থাকে। অনেক চেষ্টার পর আর এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করলেন।
ফোন ধরলো বঙ্কিমের ছেলে। দুঃসংবাদটা দিলো সে ই। মস্তিষ্কের ধমনী ফেটে সেরিব্রাল। বঙ্কিম দু বছর শয্যাশায়ী, প্যারালিসিস। ডাক্তার বলেছিলেন অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার ফল।

ভূতাবস্থান
মনোজিৎ বোস
"তাড়াতাড়ি পা চালালো নিকুঞ্জ।খালপাড়টা পার না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।এমনিতেই জায়গাটা পুরো শুনশান।স্টেশনের কাছে রাস্তায় তবু কয়েকটা ঘর, গুমটি দোকান আছে।এক আধটা বিদ্যুৎ খুঁটিতে আলোও জ্বলে।কিন্তু এদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।ঘরবাড়ি শুরু আরো ক্রোশ খানেক গেলে তারপর।দুদিকে ফাঁকা মাঠ,মাঝখানে তিরতির করে জল বয়ে যাওয়া একটা খাল।আগে কোনো একসময় নাকি নদী ছিলো,নিকুঞ্জ অবশ্য কখনও দেখেনি।তবে যেটা সে এবং এই এলাকার সবাই জানে সেটা হলো জায়গাটা ভালো না,দোষ আছে।সন্ধ্যার পর এদিকে খুব একটা কেউ ঘেঁষে না।এলেও দু"চারজন দল বেঁধে মনে মনে রামনাম জপ করতে করতে কোনওমতে পালিয়ে বাঁচে।নিকুঞ্জও আজ অবধি কোনোদিন এর অন্যথা করেনি।
কিন্তু আজ বিধি বাম।সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্টেশনের বাইরে লটারির দোকান চালিয়ে ফেরার পথে সে মাঝে মাঝে হরিদার ঠেকে একটু গলা ভেজাতে যায়। ঠেকের সঙ্গী আরো দুই বন্ধু,মুদির দোকানের দেবু আর দু ঘর পাশেই থাকা খগেন।তিনজনেই হাফপ্যান্টের বন্ধু।নেশা করে আড্ডা দিয়ে তিনজনে একসাথে খগেনের মোটর সাইকেলে ফিরে যায়।এতদিনেও কোনও বিপদ হয়নি ঠাকুরের দয়ায়।কিন্তু আজ আসবে বলেও দুজনের কারোরই দেখা নেই।আগে জানলে নিকুঞ্জ আজ ঠেকে যেতো না।ওদের অপেক্ষায় বসে বসে দু তিন গেলাস গলায় ঢালা হয়ে গেছে।শেষে নিকুঞ্জ ব্যাজার মুখে বেরিয়ে পড়লো।আজ কপালে শনি নাচছে।
আর মিনিট দুয়েক হাঁটলেই খালপাড়ের নড়বড়ে সাঁকোটা।ওটা পেরিয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত।
দু'পা গিয়েই থমকে ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো নিকুঞ্জ।বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মনে পড়তেই নেশাটা ছুটে গেলো তার,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।
তাই তো,আজ তো শনিবার, তায় অমাবস্যা!সর্বনাশ!!!
সেইজন্যই অন্ধকারটা এত জাঁকিয়ে বসেছে!!
হাঁটু দুটো একটু কেঁপে গেলো নিকুঞ্জর।বুকের ধুকপুকানির শব্দ সে যেন নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে।
নিকুঞ্জ কোনওমতে পকেট হাতড়ে একটা বিড়ি বের করে ধরালো।পিছন ফিরে একবার দেখলো যদি ভাগ্য করে কেউ এপথে আসে।যদি কাউকে দেখা যায়। নাহ্,অনেক দূরে রাস্তার একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে বটে,কিন্তু সেভাবে কিছু ঠাওর করতে পারলো না সে।মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো নিকুঞ্জর।পা দুটো যেন নড়তে চাইছে না।
নিভে যাওয়া বিড়িটা আবার ধরালো সে।বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিলো একবার।এভাবে আর কতক্ষন মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়,বাড়ি তো ফিরতেই হবে তাকে।মনে মনে রামনাম করতে করতে নিকুঞ্জ এগিয়ে গেলো সাঁকোটার দিকে।
আর পা দশেক এগোলেই সাঁকোটা।অন্ধকারে বাঁশের অবয়বটা বুঝতে পারছে নিকুঞ্জ,আর সেটা বুঝতে পেরেই আবার পা দুটো নিজে থেকেই আটকে গেলো তার।আর একবার খুব আশা করে পিছন ফিরল নিকুঞ্জ।কেউ কি আসবে না!??কেউ না!?
ক্রিং ক্রিং.....
ফাঁড়াটা মনে হয় কেটে গেলো।একটা সাইকেলের ঘন্টির শব্দ শোনা গেলো না!? হ্যাঁ, ওইতো।অন্ধকারেও নিকুঞ্জ বুঝতে পারলো একটা সাইকেল এগিয়ে আসছে ধীর গতিতে।জায়গাটা খুব অন্ধকার।মানুষের আদল বোঝা গেলেও মুখটা ঠাওর করা অসাধ্য।
যেই হোক,তাতে কিছু যায় আসে না.... নিশ্চয়ই চেনা কেউ হবে।ছোট্ট মফস্সল শহরে সবাই মুখ চেনা।আর অচেনা হলেই বা ক্ষতি কি।এই পথটুকু পার হওয়া নিয়ে কথা।
সাইকেলটা সামনে এসে থামলো।হাত দুয়েক দূরে।অন্ধকারে মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না।
- নিকুঞ্জ মনে হচ্ছে! একা কেনো রে?নেশা করে তাল জ্ঞান সব লোপ পেয়েছে না কি?
- হ্যাঁ দাদা,আমি নিকুঞ্জ।কিন্তু তোমা... মানে আপনাকে..
- চিনতে পারলিনা!?আমি রতন রে। পূবপাড়ার রতন সাহা।একটা বিড়ি দে দেখি।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো নিকুঞ্জর।রতন সাহা নামটা তার শোনা।একটা বিড়ি এগিয়ে দিলো সে। বিড়িটা দেওয়ার সময় রতনদার হাতে হাত ছুঁয়ে যেতেই কেঁপে উঠলো নিকুঞ্জ।সারা শরীরে খেলে গেলো একটা ঠান্ডা স্রোত।যেন একতাল বরফে হাত দিয়ে ফেলেছে সে।এত ঠান্ডা হয় কোনো মানুষের হাত!!
- কি রে,আগুনটা দে।
রতনদার কথায় চমক ভাঙলো নিকুঞ্জর।
কোনওমতে অস্বস্তি কাটিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটা এগিয়ে দিয়েই সে আতঙ্কে একেবারে সিঁটিয়ে গেলো।আগুন ধরা হাত থরথর করে কাঁপছে।ওই একটু আলোতেই নিকুঞ্জ বুঝতে পারলো লোকটার মুখটা অসম্ভব রকম ফ্যাকাসে,চোখ আর নাকের জায়গায় গভীর কালো গর্ত।
দাঁত গুলো মাড়ি সমেত উঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছে....সেই মুখে কোথাও রক্ত মাংস চামড়ার ছিঁটেফোঁটা নেই।
চোখের পাতাদুটো ভারী হয়ে আসছে,পা দুটো ভীষণ রকম কাঁপছে নিকুঞ্জর।জ্ঞান হারানোর আগে তার মনে পড়ে যায় বছর তিনেক আগে স্টেশনের লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় একজন রেলে কাটা পড়েছিলো.....নামটা তো রতন সাহাই ছিলো.....
অন্ধকার রাতে একটা বুকফাটা আর্তনাদ শোনা যায়.........."
ছোটবেলায় এইসব গল্প শুনে পড়ে ভয় কাঁটা হয়ে থাকতাম।রাতে আলো নিভিয়ে একা একা ঘুমোতে পারতাম না।মা কে জড়িয়ে তারপর ভয় কাটতো।জানলার বাইরে বড় নাম না জানা গাছটার দিকে অন্ধকারে দেখে মনে হয় ডালপাতা নিয়ে একটা দৈত্যের অবয়ব নিয়েছে।তখন মনে মনে শপথ নিতাম আগামীকাল থেকে ভূতের গল্প আর পড়বোও না শুনবোও না।কিন্তু তা কি হয়? ভুতের গল্পের একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণ কি কাটানো যায়? একলা দুপুরে আবার টেনে নিতাম ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস খোক্কোসদের।অথবা হানাবাড়ির হাহাকার মার্কা বইগুলোকে।তারপর শেষ না করা অবধি বুঁদ হয়ে থাকতাম।দিনের আলোয় ভয়-টয় ডোন্ট কেয়ার।কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই ভয়গুলো যেন কোন অন্ধকার থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসতো।
একসময় শহরের বুকে ফাঁকা মাঠ ছিলো, এঁদো ডোবা - পানাপুকুর ছিলো। ঝোপঝাড় আর শ্যাওড়া,অশ্বত্থ,বেল গাছ ছিলো।ঘন ঘন লোডশেডিং ছিলো। তাই ভয়গুলো সব গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সই পাতিয়ে কাছেপিঠেই থাকতো।
তারপর কালক্রমে পোড়ো বাড়ি ভেঙে বহুতল ইমারত হলো।পুকুর বুজিয়ে, ঝোপঝাড় সাফ করে মার্কেট হলো।গাছ কেটে রাস্তা হলো।শহর থেকে শহরতলি রাতেও আলোকিত হয়ে উঠল নিয়ন আলোয়।তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই আস্তে আস্তে ভয়,অন্ধকার,ছায়ার খেলা আর ভূতেরা কিছুটা দূরে সরে গেলো।
কিন্তু তাই কি?! তেনারা কি সত্যিই হারিয়ে গেলো!?আর কি তাদের অস্তিত্ব নেই!?? আছে আছে, আলবাত আছে।বাংলায় " বাংলার ভূত" না থাকলে কি চলে?ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে, পোড়োবাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে,নিঝুম রাস্তার আনাচে কানাচে,শ্যাওড়া - বেল গাছের ডালে ডালে তাদের অস্তিত্ব সংকটে হলেও বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় তারা চিরকালীন,চিরভয়ংকর।
" আহা ভূত, বাহা ভূত
কিবা ভূত,কিম্ভুত..."
সেই গুগাবাবা চলচ্চিত্রের কিলবিল করা ভূতেদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যেই ছিলো বাংলার সেইসব বিখ্যাত ভূতেরা।যাদের সাথে আমাদের আলাপ বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে আর তার সাথে বীভৎস গায়ে কাঁটা দেওয়া তাদের ছবির মাধ্যমে।মুলোর মতো দাঁত,কুলোর মতো কান,লাল রক্তজবার মতো চোখ,বড় বড় নখ.......
আসুন,একটু পরিচয় পর্ব সেরে নেওয়া যাক।
ব্রহ্মদৈত্য: সেইসব একডাকে চেনা,হাড় কাঁপানো ভূতেদের মধ্যে এলিট বা সবচেয়ে সম্মানীয় হলেন ব্রহ্মদৈত্য মশাই। অপঘাত মৃত্যুতে ব্রাহ্মণের অতৃপ্ত আত্মাই ব্রহ্মদৈত্য নামে পরিচিত।উপকারী,ভদ্র সভ্য ভূত বলে ওনার সমাদর সর্বজনবিদিত।সব ভূতেরা তাঁর কথায় ওঠবোস করে।মাথায় টিকি,খালি গায়ে সাদা পৈতে, পরণে ধবধবে সাদা ধুতি,পায়ে খড়ম।উনি সাধারণত বেলগাছেই বসবাস করেন বলে জানা যায়।মাঝে মাঝে আয়েশ করে হুঁকো টানতেও দেখা যায়। ওনার সাথে মুখোমুখি হয়ে গেলে ক্ষতির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।উল্টে বর- টর পেয়ে যেতে পারেন যদি না মূর্ছা যান।
পেত্নী: অবিবাহিতা মেয়েদের আত্মা পেত্নীদের বেশ নাম ডাক।জীবদ্দশায় অতৃপ্ত কামনা বাসনা অপূর্ণ থাকা অবস্থায় পটল তোলা এই পেত্নীরা বেশ ভয়ংকর প্রজাতির মেয়ে ভূত।যেকোনো রূপ ধরতে এরা পারদর্শিনী। সুন্দরী লাস্যময়ী রূপসী থেকে পুরুষের রূপ ধরে যে কোনও সময় আপনার ঘাড়টি মটকে দিতে পারে।এদের হাতে পড়লে রক্ষে নেই।তবে এদের একটাই শারীরিক ত্রুটি,এদের পায়ের পাতা দুটো উল্টোদিকে ঘোরানো।তাই সন্দেহ হলেই একবার আড়চোখে দেখে নিলে হয়তো বেঁচে গেলেও যেতে পারেন।
শাঁখচুন্নি: বিবাহিতা বাঙালি ভূত।হাতে শাঁখা ,সাদা-লালপেড়ে শাড়ি,সিঁথিতে সিঁদুর।সাধারণত ধনী বিবাহিতা মহিলাদের ঘাড়ে চেপে তাদের বৈবাহিক জীবনকে উপভোগ করে,যাকে বলে নেপোয় মারে দই।যতদূর পড়েছি শ্যাওড়া গাছ হলো এদের সবচেয়ে পছন্দের ডেরা।
মামদো: নামটা বেশ মজার। বলা হয়ে থাকে অপঘাতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত মুসলমান ব্যক্তির আত্মাই মামদো নামে খ্যাত।ভূত সমাজে এদের শারীরিক বিবরণ অন্যদের থেকে আলাদা।পা নেই।মাথা হাত বুক কোমর অবধি ঠিকঠাক।তারপর কোমর থেকে নিচের দিক ক্রমশ সরু হয়ে লেজের মতো হয়ে যায়।আর তাই এরা সবসময় শূন্যে ভাসমান।অনেকসময় মাথায় টুপি আর থুতনিতে লম্বা দাড়িও দেখা যায়।আর বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হলো রাতের বেলা কবরখানার আশপাশে বেশি ঘুরঘুর করবেন না,কারণ মামদোদের ডেরা হলো কবরস্থান।তাই সাবধান....
গেছো: নামেই এদের পরিচয়। গাছে থাকে তাই গেছো।বলা হয় গাছের ডালে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করা মানুষ মরে গেছো হয়।বড় বড় ঝাঁকড়া গাছের মোটা ডালে বসে কি সুন্দর পা দোলায়।আর যেই কেউ গাছের তলা দিয়ে যায় ,তখনই গেছোর খেলা শুরু।
পেঁচাপেঁচি: এরা জংলি ভূত,মানে জঙ্গলে থাকে।আসলে এরা পেঁচা ভূত। পুরুষ ভূত হলো পেঁচা আর স্ত্রী ভূত হলো পেঁচি।জোড়ায় থাকে।জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো বা পথ ভোলা একাকী পথিক পেলেই খেল খতম।
স্কন্ধকাটা: ঘাড়ের ওপর ফাঁকা, মানে মুন্ডু গায়েব আর কি।দুর্ঘটনাজনিত অপঘাতে মাথা হারানো মরা মানুষের ভূত তার মাথা খুঁজে বেড়ায়।আপনাকে সামনে পেলে আপনাকেও বশ করে মাথা খোঁজার কাজে লাগিয়ে দেবে।তাই বেগার খাটবেন কিনা ভেবে দেখুন।অবশ্য অনেক গল্পে দেখা গেছে নিজের মুন্ডু নিজের হাতে লোফালুফি করতে এরা বেশ পটু।এদের সাথে মিশলে আপনিও পারদর্শী হয়ে উঠবেন।
মেছো: খোনা গলায় মাছ চাইছে না কি কেউ? মানে সব কথাতেই চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে যদি কেউ মাছ চায় তাহলে দিয়ে কেটে পড়ুন।প্রাণ বেঁচে যেতে পারে। পুরোনো পুকুর, দিঘীর ধারে এরা থাকে,যেখানে অনেক মাছ পাওয়া যায়।কারণ এদের ধ্যান জ্ঞান ওই মাছ। আপনার রান্নাঘর থেকেও মাছ নিয়ে চম্পট দিতে পারে।জেলেদের নৌকো থেকে হামেশাই চুরি করে নেয় শুনেছি। বাজার থেকে জোড়া ইলিশ কিনে হাতে দুলিয়ে বুক ফুলিয়ে ফিরছেন বটে,কিন্তু ও মাছ আপনার ভাগ্যে নেই।সামনেই চক্কোত্তিদের বাঁশঝাড় ঘেরা ছায়াঘন পুকুর....তাই সাবধান। হেঁ হেঁহেঁ হেঁহেঁহেঁহেঁহেঁ........
কানাভুলো: অজানা অচেনা বেপথে পথ হারালে সাবধান।অচেনা যদি কেউ পথ দেখিয়ে সাহায্য করে তাহলে দ্বিগুণ সাবধান।কানাভুলোদের কাজই ওই,পথিকদের পথ দেখিয়ে পথ ভুলিয়ে দেওয়া।আর যদি তেমন হয় তাহলে দেখবেন একই পথে বারবার ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছেন। তাই একলা চলো রে বলে একা একাই বেশি চাপ নেবেন না।দলবেঁধে থাকুন।আলাদা হলেই বাজতে পারে ছুটির ঘন্টা।
আলেয়া: ঘন অন্ধকারে জলার ওপর কখনও ধিকি ধিকি কখনও টিমটিম আলো দেখে বিরহিনী রাধার মতো তালকানা হয়ে ছুটবেন না দয়া করে।আলেয়ার পিছনে দৌড়ে আজ অবধি কেউ সোনার মেডেল পায়নি।যদিও বিজ্ঞানীরা বলেন জলে পড়ে থাকা ডাল পাতা পচে গিয়ে মিথেন গ্যাস থেকে অমন আলো হয়।দেখুন,যা ভালো বোঝেন।গ্যাস ভেবে গ্যাস খেয়ে ফুস্ না হলেই হলো।
একানড়ে: তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে।একানড়েও তাই।একটা লম্বা ঠ্যাং। থাকেও ওই তালগাছে।ভুল করে খপ্পরে পড়লে পাশের তালগাছে আপনিও একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
এরা ছাড়াও বাংলার ভূতের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়,বেশ লম্বা।বাকিরাও নিজের নিজের গুণে গুণধর।যেমন চেনা মানুষের গলা নকল করে নিশুতি রাতে তিনবার গৃহস্থের নাম ধরে ডাকা নিশি,পুকুর ডোবা জলাশয়ে লোকজনকে ডুবিয়ে মারা দেও,বাঘের আক্রমণে অপঘাতে মরা মানুষের বেঘো ভূত।ঝাউ বনে লুকিয়ে থাকা ঝেয়ো ভূত,পেত্নী ডাইনিদের অনুগত ডাকিনী... আরও কত কি।এছাড়া পুরাণ থেকে রূপকথায় দাপিয়ে বেড়ানো রাক্ষস, খোক্কোস, দ্বৈত ,দানো, যক্ষরা তো আছেই।আর তাদের দোসর আছে অমাবস্যার রাত,ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি, শনি মঙ্গলবারের দোষ,শেয়ালের হুক্কা হুয়া,, ভুষুন্ডির মাঠ,কালপেঁচার ডাক।
একসময় অলস দুপুরে বা রাতের বেলা বাড়ির কচিকাঁচারা ঘিরে ধরে ভূতের গল্প শুনতো দাদু দিদাদের কাছে।গল্প যত এগোতো ছোটোদের দল সেঁধিয়ে যেতো বড়োদের কোলে। সন্ধ্যার পর মেয়েরা চুল খুলে বাইরে যেতো না। পায়েস পিঠে মাছ মাংস জাতীয় খাবার রাতে কারও বাড়িতে দেওয়ার হলে সাথে লোহা নিয়ে যাওয়া হতো।
কালের আগ্রাসনে আজকের ছোটোদের সেই অবকাশ কম।বাংলার ভূতেদের প্রতি তাদের আগ্রহ আরও কম।তাই ভূত পেত্নীর দল অভিমানে বিবাগী হয়েছে। বর্তমানে 'ভূতেদের ভবিষ্যৎ' সত্যিই সংকটে।মুলোর মতো দাঁত,কুলোর মতো কান নিয়ে তারা বইয়ের পাতায় বন্দী।
তবু আছে,তারা আছে....থাকতেই হবে....
বাংলার ঐতিহ্য ,বাংলার ভূত জিন্দাবাদ।

বাবির মারিয়াম
সোনালী চৌধুরী
বাবিদের ইস্কুল আজ ছুটি পড়ে গেল। সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে দিন দুয়েক আগে। তারপরে গত দু দিন ধরে ইস্কুলে ছিল ক্রিসমাস কার্ণিভাল। অর্থাৎ কিনা প্রভু যিশুর জন্মোৎসব আগাম পালন করা হলো, কারণ পঁচিশে ডিসেম্বর থেকেই তো তাদের বড়দিনের ছুটি পড়বে।
সকালে স্কুলে এসে বাবি বন্ধুদের সাথে লাইন করে এই কনভেন্ট স্কুলের লাগোয়া চ্যাপেলে গিয়েছিল সমবেত প্রার্থনা সভায়। স্কুলের সিসটার রা বলে এই প্রার্থনা সভার ভালো নাম হল "ক্রিসমাস স্পেশাল মাস"। প্রতিবারের মতো সবাই এক সাথে ক্যারল গাইল। বাবিও চোখ বন্ধ করে,মন দিয়ে গাইল সেই অদ্ভুত গানটা, "সাইলেন্ট নাইট,হোলি নাইট"। সে গানের সুরের জাদু কোনো দূর দেশে নিয়ে যায় তাকে। সেই যে সেই কত হাজার বছর আগে সুদূর বেথলেহেমে মধ্যরাত্রে যখন মারিয়ামের কোল আলো করে যিশু এলেন আর আকাশের তারা দেখে ম্যাজাই রা এলো উপহার নিয়ে, জুডিয়ার পাহাড় পার করে,সেই সেখানে। সেদিনই তো গরিব মেষপালক পিতা জোসেফের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন ঈশ্বরের পুত্র। বাবি চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে প্রাণ দিয়ে গেয়ে ওঠে " জয় টু দ্য ওর্য়াল্ড দ্য লর্ড হ্যাজ কাম"। সিসটার লীলা চ্যাপেলের কোণায় বসে পিয়ানো বাজিয়ে চলে সুরের ছন্দে ছন্দে। সে অদ্ভুত সুমিষ্ট বাজনার রেশ চ্যাপেল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাচীন এই কনভেন্টের থামওয়ালা বারান্দায়,বড় বড় ক্লাসঘরে। স্তরে স্তরে শুধু সুরের অনুরণন। আস্তে আস্তে সব কেমন ঝাপসা হয়ে যায় বাবির চোখের সামনে থেকে; এই চ্যাপেল,পিয়ানোটা , পাশে দাঁড়ানো বন্ধুরা, শুধু ভেসে থাকে মারিয়ামের করুণাঘন মুখখানি আর সমবেত কন্ঠে গাওয়া অপার্থিব সুরের মূর্ছনা টুকু। বাবিও আর নেই এখানে,সে এখন শুধু ঐ সুরটুকুই হয়ে ভেসে ভেসে চলেছে বেথলেহেমের পথে। মারিয়ামের কাছে যেতে হবে তাকে।
আচ্ছা মারিয়াম কি খালি জিসাসের মা? ঈশ্বরের মা কী সবার মা নয়? প্রভু যীশু নয়,বাবি বার বার চ্যাপেলটাতে আসে মারিয়ামের টানে । মনে হয় জিসাসের একার নয়,মারিয়াম তার ও মা।
ক্লাস ফাইভের বাবি অন্য দিনও যদি সকাল সকাল ইস্কুল পৌঁছতে পারে, ফার্স্ট পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ার আগে, সে আসেই এই চ্যাপেলটাতে। শান্ত, নীরব এই জায়গাটা তার খুব পছন্দের। দুধের সরের মতো লেসের কাপড়ে ঢাকা সামনের মূল বেদী বা অল্টারের ঠিক ওপরের দেওয়ালে রয়েছে এক সুন্দর মূর্তি। মা মেরীর কোলে ছোট্ট যিশু খেলা করছে। মায়ের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে কোথায় যেন যেতে চাইছে সে। আর মারিয়াম কেমন যত্নে,মমতায় দু হাতে আগলে রেখেছে তার শিশুপুত্র কে।অল্টারের ওপরে বাতি দানে তিনটে মোমবাতি জ্বলে সব সময়। অন্ধকার চ্যাপেলটাতে সেই কোমল হলুদাভ আলোতে বাবি দেখে মা মেরীর মুখ কেমন মায়ায় ভরা। আর যিশুর মুখ চোখ কী সরল, আনন্দমাখা! একটা ধুপের অচেনা মিষ্টি গন্ধ পায় সে এখানে সবসময়। লম্বা পেতলের ফুলদানে সাজানো রজনীগন্ধা আর লাল একটা ফুল,খুব কঠিন নাম তার, গ্ল্যা-ডি-ও-লাস,বাবি আস্তে আস্তে বানান করে।চ্যাপেলের এক কোণায় কালো কাঠের বেঞ্চে বসে সে অপলক চেয়ে থাকে এই সবকিছুর দিকে। কেমন ছায়াচ্ছন্ন,শান্ত,সমাহিত চারিপাশ,কেউ চিৎকার করে না,অকারণে রূঢ় কথা বলেনা।
একেক দিন স্বাতী,সুকন্যারা আসে তার সাথে সকালে। তবে বেশিক্ষণ থাকেনা ওরা। কি বসে বসে দেখিস তুই বল তো? চল মাঠে যাই। ঘন্টা পড়তে দেরী আছে। আয় না,বাবির হাত ধরে টান দেয় স্বাতী। তোরা যা, আমি আর একটু বসি, বাবি বলে। ওরা অপেক্ষা করে না। ছটফটে কিশোরীরা সব ছুটে যায় মাঠের দিকে, ঠিক যেন এক ঝাঁক প্রজাপতি। লাল সোয়েটার আর নীল স্কার্টে ওদের কে কেমন চ্যাপেলের বাগানে ফুটে ওঠা ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা গুচ্ছের মতো দেখায়। বাবি একাই বসে থাকে আরো কিছুক্ষণ চ্যাপেলের নিরালায়। মনটা খারাপ করে ওঠে ওর। সে যে কেন ওর বান্ধবীদের মতো অমন সহজ,উচ্ছল হতে পারে না?
কাঁধ থেকে ভারী স্কুল ব্যাগটা নামিয়ে রেখে মারিয়ামের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে চায় সে। মারিয়াম বকবে না তাকে,বাবির সব ভুল ক্ষমা করে দেবে নিমেষেই । যখন অনেক চেষ্টা করেও সে অঙ্ক পারেনা আর বাবার চোখ গুলো কেমন লাল,রাগ রাগ হয়ে ওঠে,দুই ভ্রুরুর মাঝখানের খাঁজটা আরো গভীর হয়ে ওঠে, বাবির চোখ দুটো নিঃশব্দে জলে ভরে ওঠে। নীল কালিতে খাতায় লেখা সংখ্যাগুলো আবছা হয়ে যায় হঠাৎই,তারপর ধেবড়ে যায়।
আমি যে অঙ্ক পারিনা মারিয়াম,কিছুতেই উত্তর মেলে না। এই সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষাতেও আমি ইংরেজি আর বাংলাতে নাইন্টি পেয়েছি,কিন্তু অঙ্কে শুধু ফরটি টু। সেই নিয়েই তো আমাকে বকল সবাই। আমি 'গুড ফর নাথিং ' মারিয়াম!
ছোট কাকু বলল তিন্নি অঙ্কে এত ভালো।আমি নিজে অঙ্কে গ্র্যাজুয়েশনে গোল্ড মেডেল পেলাম,তুমি কি পেলে বাবি? ফরটি টু ওনলি! সবাই হাসবে তোমার এমন মোটা মাথার জন্যে! শেমফুল!
বাবা কথা খুব কম বলে। এখন এই দু দিন একেবারেই কথা বলছেনা আমার সাথে। তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। আমি যে কাজে খালি ভুল করে ফেলি , কিছুতেই বাবার মনোমতো হয়ে উঠতে পারিনা। বাবা রেগে যায় খুব। কিন্তু আমি রাগাতে চাইনা বাবাকে,বিশ্বাস করো। জানো আমার শাস্তি হয়েছে মারিয়াম। বাবা বলল, গল্পের বই পড়ে পড়ে তোমার ব্রেন নষ্ট হয়ে গেছে বাবি। আজ থেকে আর একটাও বাজে বই পড়বেনা তুমি । আমি তোমার স্কুলের লাইব্রেরী টিচার কে বলে দিয়েছি যেন একটাও গল্পের বই না ই্যসু করা হয় তোমাকে। কোথায় তোমার লেখার খাতাটা?
ওটা, ওটাতো আমার কাছে নেই এখন।
এখন মিথ্যে বলতেও শিখে গেছ তুমি! দাও খাতাটা। তুমিও কি তোমার মায়ের মতো হতে চাও? তোমার মায়ের অবস্থা দেখছ তো! একদম কবিতা লিখবেনা। হাবিজাবি চিন্তা যত! অঙ্ক বই খুলে রেখে কী দেখ হাঁ করে আকাশের দিকে? গুড ফর নাথিং একটা!
বাবা প্লিজ তুমি খাতাটা নিওনা। আমি রোজ অঙ্ক করব,প্রমিস করছি।
সপাটে একটা চড় এসে পড়েছিল আমার গালে মারিয়াম । কানে একটা তীক্ষ্ম আওয়াজ ছাড়া কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ শুনতে পাইনি আমি। একদম ছুটে পালিয়ে যাবে আমি,অনেক দূরে। কিন্তু কোথায় যাবো আমি মারিয়াম?
ও বাবা সরি। বাবা প্লিজ তুমি কথা বলা বন্ধ করোনা। এই নাও খাতাটা। বাবা একটু কথা বলো।
বাবা খাতাটা নিয়ে খবরের কাগজের ডাঁইয়ের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ননসেন্স একটা মেয়ে! আসলে রক্ত,রক্ত যাবে কোথায়? কথাগুলোর মানে আমি ঠিক বুঝিনি মারিয়াম।
ছুটে আর কোথায় যাবে বাবি? কতদূরে? এমনিতেও সে খেলাধুলো ভালো পারে না। গেমস পিরিয়ডে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার জন্যে অনেকবার শাস্তি দিয়েছে সিসটার। হোয়াই আর য়ু সো লেজি এন্ড আনমাইন্ডফুল বাবি? চেহারাটা ছোট থেকেই গোলগাল তার, তিন্নির মত ছিপছিপে নয় , ছুটতে পারবেনা বাবি। তাই মারিয়ামের কাছে এসে বসে সে সুযোগ পেলে।
২.
স্কুলের পুলকারটা তাকে আর তিন্নি কে নামিয়ে দিয়ে গেল বাড়ির সামনে। আজ যদি চব্বিশ হয়, তবে কাল পঁচিশে ডিসেম্বর। এই নিয়ে পাঁচবার গুনেছে সে সকাল থেকে। কাল বড়দিন। মারিয়ামের ছেলের যোশুহার জন্মদিন। তারও তো জন্মদিন কাল,ভাবে বাবি। তাই কী নিজেকে অমন মারিয়ামের মেয়ে মনে হয় তার?
স্কার্টে কী লাগিয়ে এনেছিস তুই আবার? সামলে চলতে পারিসনা? ঘরে ঢোকামাত্রই পিসিমণির তীক্ষ্ম গলার স্বরে কুঁকড়ে যায় বাবি। এখন তার সারা শরীর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জরিপ করছেন তিনি,না দেখেও অনুভব করতে পারে বাবি। সারা পাড়া কে জানিয়ে ঘরে এলেন মহারানি! দশ পুরতে না পুরতেই.., আমাদের বংশের ধারা এমন নয় । এই সব পাগলামির লক্ষণ। শরীরে,মনে পাগলামির পোকা। রক্ত যাবে কোথায়? কোন রক্তের কথা বলে এরা বারবার? তার শরীর থেকে প্রতি মাসে যে লাল তরল নিসৃত হচ্ছে ,তার কথা বলছে? আর কী রক্ত হয়? জানেনা সে। ধাঁধার মতো মনে হয় কথাগুলো।
তিন্নি কে দেখ,যেমন বয়স তেমন। তোর মতো এতো পাকা নয়! এত ধিঙ্গী হয়েছিস, দেখলে পনেরো ষোলো মনে হয়। ক দিন হলো আজ?
সেকেন্ড ডে।
অ। বলি তোর মা জননী জানেন না তার এখনো ঘুম ভাঙেনি? বাবি এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। তিন্নি পর্দার কোণ থেকে দেখছে তাকে। বাবির লজ্জা লাগে আরো। দুমাস হলো তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। ওদের ক্লাসে আর কারোর হয়নি এখনো। বাবি কেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল? মাস দুয়েক আগে ঘুম থেকে উঠে অতটা রক্ত দেখে ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল প্রথমে। দুমাস গেলেও সে এখনো নিজেকে পরিপাটি গুছিয়ে রাখতে শেখেনি এই দিনগুলোতে। স্কার্টে বা ফ্রকে দাগ লাগিয়ে ফেলে। তখন মনে হয় ছুটে কোথাও লুকিয়ে যাবে সে, যেখানে পিসিমণি খুঁজে পাবে না তাকে। বন্ধুরা ফিসফিস করে আঙ্গুল তুলে দেখাবেনা তার স্কার্টের দিকে।
দিদিভাই লুডো খেলবি? তিন্নি ডাকে তাকে।
হ্যাঁ চল। বাবি এক কথায় রাজি। তিন্নি তার লুডো,ক্যারমের একমাএ পার্টনার।
ঘরে যাও তিন্নি তুমি। বড়দের কথায় থাকবেনা কতদিন বলেছি,কাকীমার গলা রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে। বাবি আবারো কুঁকড়ে যায়। ইশ! লজ্জা লাগছে খুব তিন্নির সামনে।
বড়দের কথা কোথায়? ও তো দিদিভাই।
হোক দিদিভাই,ও এখন বড়। তুমি ছোট এখনো। তর্ক করবেনা তুমি।
এ্যাই দিভাই,তোর কী হয়েছে রে? শরীর খারাপ?
হ্যাঁ ওর শরীর খারাপ। ওর কাছে যাবেনা তুমি দুদিন এখন। ঐ ছোঁয়া লেগে আবার আমার মেয়েটারও যদি এই বয়সে...কাকীমার গলায় চিন্তার রেশ।
যাও তুমি এখন। চেঞ্জ করবে এখুনি। রান্নাঘর আর ঠাকুরঘরে পা দিয়েছ যদি তো দেখ কী অবস্থা করি তোমার! পিসিমণির কথায় ভারী ব্যাগটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় বাবি।
লাল সিমেন্টের মেঝে থেকে তাল তাল ঠান্ডা উঠে আসে বাবির মোজার ফাঁকে। শীতের সোনালী আলো চুঁইয়ে আসছে সিঁড়ির মাথায় নক্সা কাটা কাচের বড় জানালাটা থেকে। ছোট ছোট আলোর খোপ মনে হয়। বাইরের পাম গাছটার পাতার ঝিরিঝিরি ছায়া দেওয়ালের গায়ে,তাও এত ঠাণ্ডা লাগে কেন তার? ধাপগুলো ক্লান্ত পায়ে ভাঙে সে। এই ভাবেই একের পর এক, ধাপের পর ধাপ যদি ভেঙেই যেত পারত সে অনন্তকাল ধরে? সিঁড়িটার মাথায় আর পৌঁছতে হতো না? হতে পারেনা এমন?
ঐ সিঁড়ির শেষে একজন আছে। বাবির পালাবার পথ নেই আর। যে পথেই সে যাক, সিঁড়িটা ঠিক শেষ হয়ে যাবে এখানেই। হলঘরটা পেরিয়ে শোওয়ার ঘরটা তে ঢোকে বাবি। এই দুপুরেও ঘরের জানালাগুলো এঁটে বন্ধ করা। পাল্লার মাথায় কাচের চতুস্কোণ দিয়ে আবছা আলো ঢুকছে। ঘরের কোণায় কোণায় গাঢ়,শীতল ছায়াদের রাজ্য। আলোও আসেনা তাদের কাছে। ঘরের জানালাগুলো বন্ধই থাকে বেশির ভাগ সময়। সবাই জানতে পারবে না হলে,তাই বন্ধ করেই রাখা থাকে। ঘরের আবছায়ার মাঝে বাবি সন্তর্পণে ঘাড় ঘোরায় খাটের দিকে। লাল লেপ গায়ে এক মহিলা শুয়ে আছে বিছানায়। ফ্যাকাসে মুখটা আবছায়ায় ভেসে উঠেছে কোনো অতল আঁধার থেকে। গভীর ঘুমে নিথর। খুব মৃদু নিশ্বাস পড়ছে। খোলা চুলগুলো সাপের ফণার মতো বালিশের ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘুম,ঘুম গভীর ঘুম। চোখের পাতা দুটো লেপটে আছে সে ঘোরে,যেন আর খুলবেনা কোনোদিন। মুখের চেনা আদলটা কেমন অপরিচিত লাগে বাবির। ঠোঁটের খাঁজ,ভ্রুর ভাঁজ সব যেন রবার দিয়ে মুছে দিয়েছে কেউ। শুধু শূন্য মুখের আদলটা রয়েছে,মানুষটা নেই। এমন নিথর ঘুমোলে পরিচয়ের চিহ্ন সব মুছে যায়। মানুষ আর সে মানুষ থাকেনা, বাবি কেও তো চিনতে পারে না ও মাঝেমাঝে। বলে পেটে ধরিনি আমি তোকে। বিয়েই হয়নি আমার। তবে কোথার থেকে এলি তুই? ও, ওই যে শুয়ে আছে বিছানায়। মায়ের মতোসোনালী চৌধুরী। কিন্তু মা নয়। না,না মা নয় কিছুতেই। ও মা নয়। খুব রাগী ও, খুব রাগী। গেলবার যখন আবার ওষুধ দিল বাবা, জলের গেলাস টা ছুঁড়ে মেরেছিল বাবির দিকে। কপালের কোণাটা কেটে গিয়েছিল। বাবি যখন ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত কপাল চেপে, পেছনে টলোমলো পায়ে ছুটে আসছিল ও। কপালে লেপ্টে যাওয়া সিঁদুরের টিপ, শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে, ব্লাউজের বোতাম আলগা,চুল গুলো খোলা সব অজস্র কালো সাপের মতো। হাত বাড়িয়ে অন্ধের মতো এগিয়ে আসছিল বাবির দিকে। বাবি কোথায় ছুটবে? দুটো ঘর আর বারান্দায় লুকানো যায়না। হঠাৎই কেঁদে উঠেছিল ওই মহিলা। বাবি ও বাবি। মা রে, একবার আয় এদিকে। হাহাকারের মতো শুনিয়েছিল ডাকটা। বাবি যায়নি। বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে বসেছিল যতক্ষণ না বাবা ফিরেছে। বাবা এসে সেই সাদা ট্যাবলেটটা দিল তারপর জোর করে। ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিল ও।
এখন ইস্কুল থেকে ফিরে দুটো ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে ওকে। একটা নীল মতো আর একটা কালচে লাল। বাবা অফিস যাওয়ার আগে এই কাজটা দিয়ে গেছে তাকে। মা কে ডেকে ওষুধটা খাওয়াবে তুমি। এটা তোমারই দায়িত্ব। আর পঞ্চাশটা অঙ্ক করে রাখবে আমি ফেরার আগেই।
বাবি পায়ে পায়ে দাঁড়ায় বিছানার পাশে। এই যে,যে আছে এখন এখানে,সে কোথায় নিয়ে চলে যায় তার মা কে? নিজের কোন গহনে আড়াল করে ফেলে? বাবি দেখতে পায় না আর। তখন আরো বেশি করে মারিয়ামের কাছে যায় সে।
বাবির সেই মা,যে বাবির চুল বেঁধে দেয়,জামা গুছিয়ে দেয়,গল্পের বই পড়ে শোনায়,সেই মা টা কোথায় এখন? মা যখন ভালো থাকে কতো বই পড়ে। মায়ের এক ট্রাঙ্ক বই আছে আর একটা লেখার খাতাও আছে । মা কবিতা লেখে মাঝেমধ্যে যখন ভালো থাকে। কখনো টানা বারান্দায় পা মেলে গান গায়,ঠিক যখন সন্ধ্যা হবো হবো করে। । কী যেন গানটা, " মম দুঃখের সাধন
যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে।
শুভলগন গেল চলে।
প্রেমের অভিষেক কেন হল না তব নয়নজলে।"
মা যখন চোখ বন্ধ করে গানটা গায়, বাবি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় পেছনে। মায়ের গলাটা কেমন অন্যরকম করে দেয় তার মনটাকে। বারান্দা পেরিয়ে দূরের ধুসর আকাশেও ছড়িয়ে পড়ে সুরটা। কী যেন হারিয়ে গেছে মায়ের,আর ফিরবেনা কোনোদিন। মা কে আর মা মনে হয়না। মনে হয় অনেক দূর কোনো রূপকথার দেশের এক মায়া মানবী,ভুল করে বাবিদের বাড়িতে আটকে পড়েছে। এখন মুক্তি পাওয়ার জন্যে সুরের সাধনা করছে। সুরটা অনেকক্ষণ ঘোরে বাবির মনে। আপনমনে গুনগুন করে,"মম দুঃখেরও সাধন", মানে কী কথাগুলোর?
তবে বাবা পছন্দ করেনা এসব একেবারেই। বিশেষত মায়ের জোরে জোরে গান গাওয়া আর কবিতা লেখা।
সংসারের কাজ ফেলে এমন পাগলামো কোন ভদ্র বাড়ির বউ করে? একে পাগল তায় আবার কবি। হুঃ! মেজো কে দেখে শিখতে পারো না? তোমার মাথার যে রোগ আছে তোমার বাপের বাড়ির কেউ বলেনি তো? সেয়ানা সব!পাগল মেয়ে গছিয়ে দিয়েছে ভালো মানুষ পেয়ে! এই নিয়েই তো খালি ঝগড়া হয় দুজনের। মা খুব রেগে যায়,তারপর বাচ্চার মতো হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপরেই মা কোথায় হারিয়ে যায় আর এই না-মা টা ফিরে,ফিরে আসে বারবার।
বাবি আলতো করে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে খুব আস্তে করে হাত বুলোয় মায়ের কপালে। ছড়ানো চুলগুলো গুছিয়ে দেয় একপাশে।
মা ওষুধ খাবে না তুমি? চোখ খুলে তাকায় মা, না তার মায়ের মতোই কেউ একজন? এক মুহূর্ত নিশ্বাস ধরে রাখে বাবি। মা চিনতে পারবে তাকে নাকি সেই না-মা টা আসবে আবার? হ্যাঁ এই তো মা। চোখে পরিচয়ের আলো। ঘুমের ঘোর লাগা চোখ, তবুও এটাই তো মা,বাবির মা।
ওষুধ গুলো আর জলটা কাঁপাকাঁপা হাতে খেয়ে বাবি কে টেনে কোলে বসায় মা। কখন ফিরলি সোনামা?? খাবি না কিছু? স্কার্ট টা খুলে রেখে দে,আমি ধুয়ে দেব কাল। বাবির চোখ দুটো জলে ভরে যায়। দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে সে। আর একদম যেতে দেবে না সে মা কে কোথাও।
ও মা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি? আমার কতো মন খারাপ জানো? অঙ্ক পারিনি আমি।
ধুর পাগলি মেয়ে আমার,কোথায় যাবো আবার তোকে ছেড়ে? বাবির হাত দুটো অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে হেসে ওঠে মা। অঙ্ক তো কবিতা রে। শিখিয়ে দেবো। আর ভয় করবেনা। আয় আমার কাছে সোনা মেয়েটা আমার।
মা না মারিয়াম? কাকে দেখছে বাবি? সেই এক হাসি,আলোর ঝরণার মতো। ভালোবাসার হাজার পদ্ম ফুটে উঠেছে যেন তার মুখখানিতে। এই তো তার মারিয়াম। একেই তো খুঁজতে রোজ চ্যাপেলে যায় বাবি। এর কাছেই তো ফিরবে বলে কতদিন ধরে ছুটে যাচ্ছে ছোট্ট দু পায়ে।
পৃথিবীর সব মায়েরাই কী মারিয়াম হয় বাবিদের জন্য ?

সুখই কর্তব্য, কর্তব্যই সুখ*
সোমশুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়
*২২৩০ সালের কলকাতা*
গঙ্গার ওপর ঝুলে থাকা কাঁচের সেতুগুলোয় প্রতিদিন ভোরবেলা সূর্যের আলো এসে প্রতিফলিত হয়।কলকাতা শহরটা এক বৃহৎ ও বিশেষ ধরণের কাঁচের ভিতর বন্দি। কাঁচের বাইরের তাপমাত্রা জীবন ধারণের জন্য অযোগ্য। বিশাল এক কুলিং প্ল্যান্ট শহরটাকে সূর্যের তাপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আকাশে ভেসে থাকা হোলো-ট্রামগুলো পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম। পরমাণু বিদ্যুৎ শক্তিই এই শহরটাকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ ও একমাত্র উপায়। মাটিতে হেঁটে চলা মানুষরা সবাই একরকম—চোখে ফাঁপা আনন্দ, মুখে যান্ত্রিক হাসি। এই শহরে মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় আনন্দ-সিরাম নামের এক কৃত্রিম তরল দ্বারা। প্রতিটি নাগরিকের শিরায় প্রতিদিন সকালে দেওয়া হয় এর নির্ধারিত ডোজ।
সরকারি স্লোগান:
“সুখই কর্তব্য, কর্তব্যই সুখ।”
শহরের প্রতিটি মোড়ে বিশাল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এই স্লোগান। শিশুরা সারাদিন মুখস্ত করে । সুখ মানেই বেঁচে থাকা। দুঃখ মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতা।
শারীরিক ঘনিষ্টতা আজকাল সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আদিল আর বৈষ্ণবী , দুজনে একে অপরকে পছন্দ করে। পরস্পরের সাথে যৌনতা করার এপ্লিকেশন করেছে প্রায় বছর খানেক হল। ডিপার্টমেন্ট অফ ফিজিক্যাল ইন্টিমেসিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে যোগাযোগ করে। হিন্দু ও মুসলমান হওয়ার জন্য ফাইলটা আটকে রয়েছে অনেকদিন হল।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আজ সুখস্মৃতি ডিপার্টমেন্ট এর অফিস । এখানে প্রতিটি নাগরিকের মানসিক অবস্থার সংরক্ষণ করা হয়। কারও চোখে জল দেখা গেলে তার সুখ-স্কোর নেমে যায়। কারও হাসি যদি একটু কম বা একটু দেরিতে হাসি ফুটলে, ডেটা সতর্কতা অর্থাৎ এলার্ট আসে। সাথে নেগেটিভ স্কোর চিহ্নিত হয়।
ভিক্টোরিয়ার সাদা গম্বুজ থেকে রাতে নকল চাঁদের আলো ছড়ানো হয় । শহরের মানুষ ভাবে আকাশ এখনও তাদেরই, অথচ তারা ভুলে গেছে, আসল চাঁদ আর অনেকদিন হলো ঢাকা পড়ে গেছে ধোঁয়ার আড়ালে।
অর্ণব—বয়স তেইশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু সেখানে আর সাহিত্য পড়ানো হয় না। তার কোর্সের নাম রাষ্ট্রীয় সুখতত্ত্ব। এখানে শেখানো হয় কীভাবে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, কীভাবে নাগরিকদের উৎপাদনশীল রাখা যায়, এবং কীভাবে দুঃখকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়।
সকালে সে দাঁড়িয়েছিল ইনজেকশন সেন্টার–এর লাইনে। চারপাশে আরও শত শত মানুষ। সবাই নিঃশব্দ, শুধু যান্ত্রিক গুঞ্জন বাজছিল—সিরাম-ড্রিপ মেশিনের।
একজন সার্ভো-নার্স ধাতব কণ্ঠে বলল—
“ইউনিট 7-বা ( অর্ণব এর স্টেট্ ইনডেক্স রোল ( SIR) ) সামান্য বিচ্যুতি—আজ ডোজ ডেফার্ড। রক্তে সুখ সূচক যথেষ্ট আছে ”
অর্ণবের মাথার ভেতর যেন হঠাৎ ফাঁকা একটা জায়গা তৈরি হলো। সে প্রথমবার শুনল শহরের গুঞ্জন, ট্রামের শিস, মানুষের নিঃশ্বাস—সবকিছু অন্য রঙে বাজছে।
বাড়ি ফেরার পথে অর্ণব কলেজ স্ট্রিট হয়ে ফিরবে। এখানে আছে মেমরি-মডিউল বুটিক। ভেতরে রাখা আছে ডিজিটাল চিপ, যেখানে শেক্সপিয়র বা রবীন্দ্রনাথের এডিটেড সংস্করণ পাওয়া যায়—সব দুঃখ কেটে ফেলে, কেবল “অনুমোদিত সুখ” রেখে দেওয়া হয়েছে।
একজন নাগরিক কিনল জুলিয়াস সিজার–এর সংস্করণ, যেখানে “মৃত্যু” শব্দটা নেই, বদলে আছে “সমাপ্তি অনুমোদন”।
অর্ণব হঠাৎ অনুভব করল, তার গলায় একটা খচখচে তৃষ্ণা জমেছে। কিছু যেন ভুল হচ্ছে—কিন্তু কী ভুল, সে তা বলতে পারছে না।
তার মনে হলো, হয়তো সুখকে যদি ডোজে ডোজে মাপা যায়, তবে তা আর সত্যিকারের সুখ নয়।
আনন্দ-সিরাম এর ডোজ না পড়লেই এসব উল্টোপাল্টা জিনিস মনে আসে। আদিল আর বৈষ্ণবীর কমন ফ্রেন্ড অর্ণব। নিজে হাতে ওদের সঙ্গম আবেদন পত্র জমা করে এসেছে। ফিজিক্যাল ইন্টিমেসিতে। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অফিস। আজ বিরক্ত লাগছে। সতের বার , না না , আঠারো বার , গত ২৫শে বৈশাখ ও তো। দুজনের নাম ভাঁড়িয়ে দালাল ধরে মিলিত হয়েছ। এমনিতে ইন্টিমেসি ডিপার্টমেন্ট ছয়মাস এর মধ্যে একবার এর বেশি ঘনিষ্ট হওয়ার অনুমতি দেয়না। গত বছর তিন এ ওরা সে নিয়ম ভেঙেছে। রাষ্ট্রের বিরোধিতা জেনেও । গোপনে।
অর্ণব আর বৈষ্ণবী কলকাতা হ্যাচারিতে এপ্লাই করেছে ,বাচ্চার জন্য। । এখন থেকে এপ্লাই করলে প্রায় বছর দশেক পরে বাচ্চা পাওয়া যায়। সব কলেজেই বিভিন্ন হ্যাচারির ক্যাম্প বসে। কাপল হিসেবে আবেদন করতে হয়। অর্ণব ও আর বৈষ্ণবী অনেক গবেষণা করে আবেদন করেছে। মেয়ে সন্তান। ডিজিটাল জেনেটিক রি- ইঞ্জিয়ারিং এর মাধ্যমে প্রায় আড়াইশো বছর পুরোনো এক কম্বিনেশন অর্ডার করা হয়েছে। অর্ণব আর বৈষ্ণবী দুজনই রিং ফাইট এর ভক্ত। মেরি কম নামের বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্ম নেওয়া এক বক্সার অর্ডার করেছে।
আদিল এর প্রস্তাব খুশি মনে মেনে নিয়েছিল অর্ণব ও বৈষ্ণবী। আজ সিরামের প্রভাবটা না থাকায় , একটু কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। ব্ল্যাকে আনন্দ সিরাম নিতে হবে। নইলে এতদিনের সম্পর্কে ক্ষতি হবে। কলেজস্ট্রীটে ব্ল্যাকে আনন্দ সিরাম পাওয়া যায়। সেই জন্যই আসা মূলত। দুঃখ পাওয়া মানে আবার রাষ্ট্রের বিরোধিতা। একই কারণে এতবার রাষ্ট্রবিরোধিতা ঠিক না।
*(২ )*
অর্ণবের মাথার ভেতর একটা শূন্যতা কাজ করছিল। প্রতিদিন সকালে সিরামের ডোজ তার রক্তে বয়ে গিয়ে সমস্ত প্রশ্ন মুছে দিত। কিন্তু আজ, প্রথমবার, সেই ফাঁক থেকে প্রশ্নগুলো মাথা তুলছে।
বাড়ি ফিরে সে দেখল, দেওয়ালে বড় স্ক্রিনে আবারও সরকারি প্রচার—
“সুখই মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।”
অর্ণব স্ক্রিনের দিকে তাকাল, কিন্তু তার ভেতর কোনো উচ্ছ্বাস জাগল না। বরং মনে হলো, শব্দগুলো ফাঁপা, যান্ত্রিক। আসলে ব্ল্যাকে নেওয়া সিরামের কোয়ালিটি সবসময় ভালো হয় না, মাথায় সুখ চড়তে বেশিরভাগ সময় বেশ দেরি হয়
অর্ণবের বাবা-মা সিরামের নিয়মিত ভোক্তা। প্রতিদিন সকালে তারা ডোজ নেওয়ার পর হাসিমুখে বসে থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য নির্দেশনায় তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অর্ণবের মা মৃদু গলায় বললেন,
“বাবা, তোমাকে অস্বাভাবিক লাগছে। H-Score–এ কমতি আসবে না তো?”
অর্ণব জোর করে হাসল। “না মা, আমি ভালোই আছি।”
আনন্দ-সিরামের কাজ খুবই সহজ। প্রথমত মস্তিষ্কের কর্টেক্সে আবেগ নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয়ত অতীত স্মৃতি মুছে ফেলা বা ধূসর করে দেওয়া আর প্রতিটি নাগরিককে উৎপাদনশীল রাখা।
কেউ যদি ডোজ না নেয়, তাহলে তার মনে ভেসে উঠতে পারে নিষিদ্ধ আবেগ—দুঃখ, ভয়, রাগ, এমনকি প্রেমও। এগুলো রাষ্ট্রবিরোধী, কারণ এগুলো মানুষকে অসংগতিপূর্ণ করে তোলে।
অর্ণব আজ সেই অসঙ্গতির প্রথম স্পর্শ পেল। প্রথমবার।
সন্ধ্যায় দরজায় কড়া পড়ল। মীরা—অর্ণবের বন্ধু। আগে সে নাটকে অভিনয় করত, কিন্তু এখন কাজ করে সরকারের সুখ-গবেষণা কেন্দ্রে।
মীরা চুপচাপ ভেতরে ঢুকে বলল,
“তোর ডোজ হয়নি শুনেছি। ”
অর্ণব বিস্মিত—“ তুই জানলি কীভাবে?”
মীরা চোখ নামিয়ে বলল, “আমাদের কাছে সব ডেটা আসে। H-Score–এর সামান্য ওঠানামাও রিপোর্ট হয়।”
অর্ণব একটু থেমে বলল, “তুই কি কখনও ভেবেছিস, সত্যি কি আমরা সুখী? নাকি শুধু অভিনয় করছি?”
মীরা প্রথমে কিছু বলল না। তারপর খুব আস্তে বলল, “চুপ কর। এই প্রশ্নগুলোও স্ক্যান হয়। তবু…”—সে একটু থামল—“… তোকে যে বললাম , কলেজ স্ট্রিট এ গিয়ে ডোজটা নিয়ে নে। নিসনি ?
অর্ণব : নিয়েছি , প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেল। মুখে হাসিটা জাস্ট আনতে পারছি না
মীরা : আনতে পারছিনা বললে হবে নাকি। আমার কাছে দুবার এলার্ট এসেছে। ভাগ্গিস আজ আমি এসাইন ছিলাম। না হলে কি হতো ভাবতে পারছিস ? এসব করিস না।
মীরা এসব যখন বলছে , তার মুখেও সেই হাসিটা। যেটা ক্রমাগত সরকার স্ক্যান করে চলেছে।
হাসিটা মুখে মীরা খুব কাছে এসে বসল অর্ণবের। অর্ণবের অস্বস্তি হচ্ছিল , এতটাই কাছে।
তারপর মীরা ব্যাগ থেকে পাতলা এক টুকরো কাগজ বের করল। শহরে কাগজ মানেই বিরল। কাগজ রাখার জন্য মীরা এরেস্ট ও হতে পারে।
বাইনারি তে লেখা লেখা ছিল:
“সিরামবিহীন প্রত্যয়: ঘাটের ডাকে।”
সাথে আঁকা তিনটি চিহ্ন আর একটি কবিতার লাইন—
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল…”
অর্ণব অবাক হয়ে কাগজের দিকে তাকাল।
মীরা ফিসফিস করে বলল, “এটা কোনো রুট-ম্যাপ নয়, এটা একটা দরজা। শহরের ভেতরে আরেক শহর আছে। সিরাম ছাড়া যারা বাঁচতে শিখেছে—ওরা গান গায়, ওরা কাঁদে, ওরা প্রেমে পড়ে। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”
অর্ণবের ভেতর একসাথে ভয় আর কৌতূহল কাজ করল।
সে জানত, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।
*৩*
রাত নেমেছে। কলকাতার আকাশচুম্বী কাঁচের অট্টালিকা আর ভাসমান ট্রামগুলোর আলো শহরটাকে এক বিচিত্র নীলচে কুয়াশায় ঢেকে দিয়েছে। মানুষের ফ্ল্যাটগুলো থেকে একে একে নিভছে আলো, কিন্তু অদৃশ্য ড্রোনেরা এখনও ছুটে বেড়াচ্ছে—নাগরিকদের H-Score পরীক্ষা করতে।
অর্ণব আজ অস্বাভাবিকভাবে সজাগ। সিরামের অভাব তার মস্তিষ্কে এক ধরনের অচেনা সুর তৈরি করেছে। শহরের যান্ত্রিক গুঞ্জন হঠাৎ ভিন্ন রঙে ধরা দিচ্ছে—ট্রামের ভাসমান দুলুনি যেন নদীর ঢেউ, শহরটা কি তাকে কিছু বলতে চাইছে?
মীরার বার্তা
হঠাৎ অর্ণবের ডিভাইসে এক ঝলক নোটিফিকেশন—
“ভিক্টোরিয়া সাউথ লন। ২৩:৩০। কোনো শব্দ নয়, শুধু হাঁটা।”
মীরার মেসেজ।
অর্ণব সময়মতো সেখানে পৌঁছাল। আকাশে তখন চাঁদের দ্যুতি। মাঠে দু’জন পাশাপাশি হাঁটছিল। এ নীরব হাঁটাই ছিল তাদের গোপন ভাষা—কারণ রাষ্ট্রীয় স্ক্যানার শব্দ ও ছন্দ চিনে ফেলে, কিন্তু নীরব হাঁটার ফাঁকগুলো ধরতে পারে না। গোপন কথা আলোচনা করার এই কলকাতার নাগরিক কৌশল।
মীরা বলল, “শহরের ভেতরে আরেক শহর আছে। সিরাম ছাড়া যারা বাঁচতে শিখেছে—ওরা গোপনে গান গায়, কাঁদে, হাসে। কাল রাতে ঘাটে তিনবার আলো জ্বলে উঠবে। সেটাই সংকেত।” সব আলোচনা চলছে পায়ের ছন্দ মাধ্যমে।
অর্ণবের বুক ধুকপুক করছিল। সে জানত, এ মুহূর্ত থেকে সে রাষ্ট্রবিরোধী। এসব আলোচনাও রাষ্ট্র বিরোধিতা। ভয়ানক কৌতূহল হচ্ছে অর্ণবের।
রাত বাড়ল। অর্ণব বাসায় ফিরতেই দরজায় টোকা পড়ল—অডিট-ড্রোন।
“ইউনিট 7-B, আজ ডোজ হয়নি। অনুগ্রহ করে হেসে দেখান। আপনার জন্য মাইক্রো-ডোজ প্রস্তাবিত হল ।" ড্রোন থেকে নোটিফিকেশন এলো অর্ণবের ডিভাইসে।
ড্রোন সতর্ক করে সরে গেল, কিন্তু দেয়ালে রেখে গেল এক অদৃশ্য চিহ্ন—রাষ্ট্র এখন তাকে নজরে রেখেছে।
অর্ণব জানল, আর ফেরার পথ নেই। আগামীকাল রাত বারোটায়, গঙ্গার ঘাটে, আলো তিনবার জ্বলবে। সেখানেই শুরু হবে তার নতুন যাত্রা।
*8 *
গঙ্গার বুক ঢাকা কুয়াশা, তার ভেতর থেকে জেগে ওঠা মৃদু আলো। তিনবার চোখ টিপে জ্বলে উঠল সেই আলো—মীরার দেওয়া সংকেত। অর্ণব নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।
অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল ছোট্ট নৌকা। পাল্লার কাছে বসে আছে এক কিশোরী—বারো-তেরোর বেশি বয়স নয়। চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা।
“তুমি 7-B?” সে জিজ্ঞেস করল।
অর্ণব মাথা নাড়ল।
“আমি অহল্যা । এসো। আমরা দেরি করতে পারব না।”
অর্ণব নৌকায় পা রাখতেই জল কেঁপে উঠল। ওপরে ড্রোন-ব্রীজের লাল আলো ভাসছিল, কিন্তু অহল্যা নীরবে যন্ত্রে হাত দিল—হাম-মড গুঞ্জন তুলল। শব্দটা নদীর ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে গেল, ড্রোনেরা এটাকে সাধারণ পরিবেশগত শব্দ ভেবে উপেক্ষা করল।
এই যন্ত্রটা অর্ণবের চেনা। মীরা ওকে সেদিন কলেজস্ট্রীট এ পাঠিয়েছিল। ব্ল্যাকে ডোজ নিতে না।
কলেজ স্ট্রিটের মেমরি-বুটিকের পাশে এক বৃদ্ধ অর্ণবকে ডাক দিল।
“আমি দাস। একসময় লাইব্রেরিতে কাজ করতাম। এখন শব্দের আড়ালে কাজ করি।”
সে টেবিলের নিচ থেকে এক ধাতব বাক্স বার করল। ভেতরে ছোট যন্ত্র, টুকটুক করে আলো জ্বলছে।
“এগুলো হাম-মড—গোপন যন্ত্র। শহরের যান্ত্রিক গুঞ্জনের ভেতরে আমরা নিজেদের সংকেত ঢুকিয়ে দিই। রাষ্ট্র ভেবেই নেয় এগুলো স্রেফ শব্দ। কিন্তু আমরা এভাবেই বার্তা চালাই।”
অর্ণব থমকে বলল, “কার কাছে?”
“তাদের কাছে যারা এখনও প্রশ্ন করতে জানে। নদীর ওপারে, ঘাটের ডাকের মানুষদের কাছে।”
নৌকা গঙ্গার মাঝ বরাবর যেতে যেতে অর্ণব দেখতে পেল দূরে এক বালুচর। অন্ধকারের মধ্যে আগুনের আভা, মানুষের ছায়া, কিছু অস্থায়ী ছাউনি।
“ওটাই আমাদের ঘাঁটি,” অহল্যা বলল।
“কীভাবে বাঁচো এখানে?”
“আমরা সিরাম নিই না। আমরা কাঁদি, হাসি, প্রেম করি। ভয়ও পাই। সেই ভয়ই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।”
অর্ণব কেঁপে উঠল। ভয়—শহরে যেটা নিষিদ্ধ। অথচ এই মানুষগুলো ভয়কে বেছে নিয়েছে।
বালুচরে নামতেই কয়েকজন এগিয়ে এল। তাদের পোশাক ছেঁড়া, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তাদের ভেতর থেকে একজন এগিয়ে এল—গাঢ় নীল শাল কাঁধে, কণ্ঠে দৃঢ়তা।
“স্বাগতম, অর্ণব। আমরা ঘাটের ডাক।”
অর্ণবের চোখে পড়ল—মীরাও সেখানে বসে আছে।
“তুই?” অর্ণব বিস্ময়ে বলল।
মীরা হেসে মাথা নুইয়ে বলল, “কাজের ভেতর থেকে খবর চুরি করে আনতে হয়। শহরটা যদি শুধু সুখে ডুবে যায়, তবে ইতিহাস হারিয়ে যাবে।”
নীল শালে মানুষটি বলল,
“রাষ্ট্র মানুষকে যন্ত্র বানাতে চায়। আমরা মানুষকে মানুষ রাখতে চাই। এজন্য দরকার শব্দ—প্রশ্ন, গান, কান্না। তুমি কি প্রস্তুত? সিরাম ছাড়া বাঁচতে, দুঃখকেও আলিঙ্গন করতে?”
ঘাটের ডাকের আগুন জ্বালানো রাত।
সবাই প্রস্তুত— এবার তারা সুখ-আর্কাইভের যান্ত্রিক সুখে চিড় ধরাবে। অর্ণবের ওপর ভরসা আছে মীরার। মনে মনে অর্ণবকে ভালোবাসে মীরা।
মীরা অর্ণবের হাত ধরে বলল—
“এবার যদি আমরা পারি, আগামীকাল শহরের মানুষ আবার কাঁদতে পারবে।”
অর্ণব চোখ নামিয়ে রাখল। তার ঠোঁটে কম্পন।
(৫)
আকাশ ফুঁড়ে হঠাৎ নামল ড্রোনের ঝাঁক। লাল আলো ঝলসে উঠল। গর্জন কেটে দিল গঙ্গার রাতের নীরবতা।
সবাই চারদিকে তাকিয়ে হতভম্ব।
মীরা চিৎকার করে উঠল—
“বিশ্বাসঘাতক?”
সব চোখ ঘুরে গেল অর্ণবের দিকে।
দাসদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
“তুই?”
গোটা দলটা বামাল সমেত গ্রেপ্তার
অর্ণব ধীরে ধীরে মাথা তুলল।
তার ঠোঁটে এক ঠান্ডা হাসি।
“হ্যাঁ। আমি রাষ্ট্রের চর। আমাকে পাঠানো হয়েছিল তোমাদের ভরসা অর্জন করতে, তোমাদের ভেতরের সব গোপন খবর বের করে আনতে। তোমাদের বিদ্রোহের স্বপ্নে আমি ছিলাম ফাটল।”
শব্দগুলো যেন ছুরি। মীরার চোখ ভিজে গেল, কিন্তু সে তবু কিছু বলল না।
ড্রোনের ধাতব কণ্ঠ বাজল—
“রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ শনাক্ত। সমস্ত নাগরিক গ্রেপ্তার।”
এক এক করে সবাইকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। মীরাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সে ফিসফিস করে বলল—
“অর্ণব, তুই সুখ কিনেছিস, কিন্তু নিজের আত্মাকে বিক্রি করেছিস।”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল—
“রাষ্ট্রই আত্মা। বাকিটা মায়া।”
পকেট থেকে ডিভাইস বার করে নির্দেশের সুরে অর্ণব বললো।
আদিল আর বৈষ্ণবীর এপ্লিকেশনটা এপ্রুভ করে দাও। টাইম কাল সকাল সাড়ে দশটা। দুপুর একটার সময় বৈষ্ণবীকে এরেস্ট করবে। কোনো ড্রোন না। আমি নিজেই জেরা করব। ওর দিদির কাছাকাছি যেতে বেচারা অনেক হেল্প করেছে। কাল সকালে আদিলকে ওভার ডোজ করবে। ও যাতে একটা সাইবর্গ এর মতো আচরণ করে , মীরার বোনের সাথে। মীরাকে আমি নিজে দেখে নেবো।
কি বলছো? শয়তান। হা হা
আর হ্যাঁ আদিল কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাবে। আমি বাকিটা সুপর্ণাকে বলে দেব। আমাদের হাতে ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমান নেই। সাতদিনে সুপর্ণা ওকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দেবে।
রাষ্ট্রই আমার সুখ। বাকিটা রাষ্ট্রের জন্যই। ভালোবাসা আই মিন সো কল্ড বা টর্চার আই মিন রিয়েল ওয়ান।
কি ? না , আমার কোনো বন্ধু নেই। রাষ্ট্রই আমার একমাত্র বন্ধু।
“সুখই কর্তব্য, কর্তব্যই সুখ।”
Copyright © 2025 আক্ষরিক - All Rights Reserved.
Powered by GoDaddy
We use cookies to analyze website traffic and optimize your website experience. By accepting our use of cookies, your data will be aggregated with all other user data.